মুখ ফেরাল থানা, হোটেলকর্ত্রীর চেষ্টায় উদ্ধার কিশোরী

নিরাশ্রয় কিশোরী পথে পথে ঘুরছিল। থানাতেও গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সাহায্য করা দূরে থাক, মেয়েটিকে থানা থেকে স্রেফ তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় একটি ঝুপড়ি হোটেলের কর্ত্রী নিজের চেষ্টায় মেয়েটিকে তার বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন।

Advertisement

বিমান হাজরা

ফরাক্কা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৩
Share:

অপহৃতা কিশোরীর উদ্ধারকর্ত্রী অজন্তা হালদার।—নিজস্ব চিত্র।

নিরাশ্রয় কিশোরী পথে পথে ঘুরছিল। থানাতেও গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সাহায্য করা দূরে থাক, মেয়েটিকে থানা থেকে স্রেফ তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় একটি ঝুপড়ি হোটেলের কর্ত্রী নিজের চেষ্টায় মেয়েটিকে তার বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন।

Advertisement

অভিযোগের আঙুল ফরাক্কা থানার দিকে। মেয়েটি আদতে ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জের বাসিন্দা। রবিবার ফরাক্কায় এসে সাহেবগঞ্জের বোরিও থানার পুলিশ আধিকারিকরা ওই কিশোরীকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তার বাড়ির লোকেরাও সঙ্গে ছিলেন।

কিন্তু ফরাক্কা থানা মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কেন? জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “বিষয়টি জানা মাত্রই তদন্ত শুরু করেছি। অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঝামেলার কাজ মনে করে পুলিশ দায়িত্ব এড়ালে, তা কোনও মতেই মেনে নেওয়া হবে না।”

Advertisement

ফরাক্কা থানা কী বলছে? ঘটনাটা মেনে নিলেও থানার দাবি, ভাষার সমস্যাতেই যত ভুল বোঝাবুঝি। আইসি উত্তম দালাল বলেন, “মেয়েটি বুধবার সকালে থানায় এসেছিল। তবে সে হিন্দিভাষী। তাই হয়তো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”

হিন্দি বুঝতে না পারার অছিলায় কোন যুক্তিতে অসহায় নাবালিকাকে থানা থেকে তাড়িয়ে দিল পুলিশ? মেয়েটিকে উদ্ধার করেছেন যে হোটেলকর্ত্রী, সেই অজন্তা হালদারের বয়ানও মিলে যাচ্ছে কিশোরীর সঙ্গে। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যখন দ্বিতীয় বার থানায় যান, তখনও পুলিশ গা-ছাড়া আচরণ করে বলে তাঁর দাবি।

মেয়েটি ঝাড়খণ্ড থেকে ফরাক্কায় এল কী ভাবে? বোরিও থানার ওসি বিজয় সোরেন জানান, ২০০৯ সালে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে গিয়ে আর খোঁজ মেলেনি কেওড়াতলা গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণির ওই ছাত্রীর। কিশোরীর বক্তব্য, এত দিন ধরে তাকে একটি ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখে অত্যাচার চালিয়েছে ওই শিক্ষক ও তার সঙ্গীরা। মঙ্গলবার রাতে কোনও রকমে পালাতে সক্ষম হয় সে। কাছেই একটা স্টেশন ছিল। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে পড়ে। বুধবার ভোরের আলো ফুটতে যে স্টেশন আসে, নেমে পড়ে সে। সেটাই ফরাক্কা। স্টেশনে জনে-জনে সাহায্য চাইলেও ঝামেলার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। শেষে এক রিকশাচালক তাকে থানার পথ দেখিয়ে দেন।

ভাগ্যে অবশ্য এর পর আরও ভোগান্তি ছিল। থানা থেকে সাহায্য তো কোন ছার, এক রকম তাড়িয়েই দেওয়া হয় কিশোরীকে। তার কথায়, “থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে পুরো ঘটনাটা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি আমার কোনও কথাই শুনতে চাননি। বেরিয়ে যেতে বলেন। যাচ্ছি না দেখে পাহারাদারকে বলেন আমাকে থানা থেকে বের করে দিতে।”

থানার পাশেই হোটেল ও চায়ের দোকান চালান অজন্তাদেবী। তাঁর নজরে পড়ে, ওই কিশোরী থানার সামনে গাছের নীচে বসে কাঁদছে। তিনি কিশোরীকে নিয়ে ফের থানায় যান। তখন ডিউটিতে ছিলেন এক সাব ইনস্পেক্টর। অজন্তাদেবী তাঁকে কিশোরীর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে বলেন। “কিন্তু এসআই কিছু শুনতে চাননি। উল্টে বলেন, অত যদি দরদ নিজের বাড়িতে গিয়ে রাখো।”

অগত্যা মেয়েটিকে নিজের বাড়িতেই নিয়ে যান বিবাহবিচ্ছিন্না, এক মেয়ের মা অজন্তাদেবী। তারপরে নিজেই পরিচিত লোকজনদের সাহায্যে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করেন বোরিও থানার সঙ্গে। এত দিন কন্যার মতোই যত্নে নিজের কাছে রেখেছিলেন সেই কিশোরীকে। ঝাড়খণ্ড পুলিশের সঙ্গে এসেছিলেন কেওড়াতলা গ্রামের মুখিয়া মিনা বাসকি। তিনি বললেন, “অজন্তাদেবীর ভূমিকা যত ভাল, থানার ভূমিকা তত ন্যক্কারজনক।”

ঝাড়খণ্ড পুলিশ এত দিন মেয়ের খোঁজ করেনি? ঝাড়খণ্ড পুলিশের দাবি, সব রকম চেষ্টা করেও মেয়ের হদিস মেলেনি এই সাড়ে চার বছরে। এর মধ্যে মেয়ের মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ৩৬৬, ১২০বি ও ৩৪ ধারায় মামলা রুজু হয় গৃহশিক্ষকের বিরুদ্ধে। তিনি গ্রেফতারও হন। পরে গৃহশিক্ষক পাল্টা মামলা করে দাবি করেন, কিশোরীকে তার বাড়ির লোকেরাই লুকিয়ে রেখে মিথ্যা মামলা করছে। সে মামলা এখনও চলছে সাহেবগঞ্জ আদালতে। যদিও এই মামলা-পাল্টা মামলার মধ্যে মেয়েটিকে কী করে তিনি সকলের চোখ এড়িয়ে এত দিন বন্দি রাখলেন, তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে। সোমবারই সাহেবগঞ্জ আদালতে ওই কিশোরীকে ১৬৪ ধারায় গোপন জবানবন্দি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার এই ঘটনায় রাজ্য পুলিশের যে নিন্দনীয় ভূমিকা দেখা গেল বলে অভিযোগ, সেটা মানতে পারছেন না ফরাক্কাবাসী। স্থানীয় তৃণমূল নেতা দুলাল ঘোষ বলেন, “থানার এই গা-ছাড়া ভূমিকা অত্যন্ত নিন্দার। পুলিশ সুপারের উচিত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন