কৃষ্ণনগর দ্বিজেন্দ্রলাল পাঠাগারে ভিড়ের বহর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
নিজের ভিটেতেই উপেক্ষিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়!
প্রতিবছর যেখানে সাড়ম্বরে পালিত হয় তাঁর জন্মদিন, এ বছর সকালে সেখানে প্রায় নমো নমো করেই সারা হল উৎসব। জনসাধারণ থেকে কর্তাব্যক্তি সকলের উপস্থিতিই ছিল চোখ পড়ার মতো কম। তাতে হতবাক স্মৃতিরক্ষা কমিটি।
ইংরেজির ১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন হলেও, অন্য বছরের মতো এ বারও বাংলা সনের হিসেবে ৪ শ্রাবণ তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়েছে। কৃষ্ণনগর স্টেশনের পাশে কবির জন্মভিটেয় দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতি ও কৃষ্ণনগর পুরসভার যৌথ উদ্যোগে ১৫২ তম দ্বিজেন্দ্র জন্মোৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাল কাটল। নির্দিষ্ট সূচিতে থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রভাতফেরি করা সম্ভব হল না। উদ্যোক্তাদের দাবি, দায়িত্ব নিয়ে প্রভাতফেরি করার মতো লোকই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিও প্রায় ছিল না বললেই চলে। দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতির সম্পাদক বাসুদেব মণ্ডল বলেন, “বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রায় একশো জন ছাত্রছাত্রীর আসার কথা ছিল। কিন্তু একটা স্কুল থেকে মাত্র ন’জন ছাত্রী এসেছিল। লোকের অভাবেই শেষ পর্যন্ত আমরা প্রভাতফেরিটা করে উঠতে পারলাম না।” কিন্তু কেন এমনটা হল তা কিছুতই বুঝে উঠতে পারছেন না বাসুদেববাবুও। প্রতিবারই এই দিনটিতে সকাল থেকে দ্বিজেন্দ্র পাঠাগারের সামনের মাঠে কবির জন্মোৎসব পালন করা হয়। প্রতিবারই যথেষ্ট উৎসাহে অনুষ্ঠান করা হয়। স্থানীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ, স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর ভিড়ও থাকে। কিন্তু এ বছর মঞ্চের নীচে উৎসাহী মানুষের ভিড় যেমন চোখে পড়েনি। তেমনই দেখা যায়নি মঞ্চের উপরের চেনা মুখগুলোকেও, দাবি উদ্যোক্তাদের। সোমবার সকালে কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা কবির মূর্তিতে মালা দিয়েই চলে যান। এসেছিলেন জেলাশাসক পিবি সালিমও। কিন্তু দেখা যায়নি জেলার মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বা কৃষ্ণনগরের বিধায়ক অবনীমোহন জোয়ারদারকে। এমনকী পুরসভার উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেখা পাওয়া যায়নি কাউন্সিলারদেরও। জানা গিয়েছে তাঁরা বেশিরভাগই চলে গিয়েছেন কলকাতায়, শহিদ দিবস পালন করতে।
বাসুদেববাবু হতাশ গলায় বলেন, “পুরপ্রধান এলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। প্রতিবছর মন্ত্রী, বিধায়করা আসেন, এবার তাঁরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন আসতে পারবেন না।”
আসলে এঁরা সকলেই যে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছেন কলকাতায়। সে কথা স্বীকারও করেছেন প্রায় সকলেই। মন্ত্রী উজ্জ্বলবাবু বলেন, “আজ যে আমাদের শহিদ দিবস। তাই কলকাতায় চলে এসেছি।” একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অবনীমোহনবাবু বলেন, “শহিদ দিবসে উপস্থিত থাকতে হবে বলে আমি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থাকতে পারিনি। সেটা আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।” পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন, “আমি সকালে কবির জন্মভিটের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু তারপরে দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার জন্য কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।”
বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা কমিটি। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন শুধু নেতা মন্ত্রীরা নন, বহু সাধারণ উৎসাহী মানুষ সোমবার চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তবে দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠানে একেবারে বিমুখ করেননি কৃষ্ণনগরবাসী। দ্বিজেন্দ্র পাঠাগারের মাঠে রাত পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছিল নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সেখানে ছোটছোট ছেলেমেয়ে এবং তাঁদের অভিভাবকদের উপস্থিতি ছিল অন্য বছরের মতোই।
একই চিত্র পুরসভার দ্বিজেন্দ্র মঞ্চেও। তাবড় জনপ্রতিনিধির দেখা না পাওয়া গেলেও স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। অথচ এই কবিকে নিয়েই গর্ববোধ করেন কৃষ্ণনগরবাসী। দ্বিজেন্দ্র পাঠাগারের পরিচালন সমিতির সম্পাদক ও রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি টাস্ক ফোর্সের সহ-সভাপতি স্বপন মৈত্র বলেন, “শহরের মানুষ কবির থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এটা ভাবতেই কষ্ট হয়। কিন্তু এটাই বাস্তব। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিতির হার কমছে। শিল্প-সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে চাইছেন।” দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতির সদস্য রামকৃষ্ণ দে বলেন, ‘‘ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে যে নিজের জন্ম ভিটেতেই উপেক্ষিত হলেন কবি। অন্যদের কথা ছেড়েই দিন, ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি মাত্র ন’জন। এই শহরের মানুষের কাছে এর থেকে বেশি সম্মান পাওয়ার কথা কি কবির ছিল না?’’