ভরা শীতেও ভাঙন-ভ্রূকুটি দুই জেলায়

মাঝে শুধুই রাজ্য সড়ক, আতঙ্ক

বৃহস্পতিবার রাত থেকে পদ্মা পাড় ভাঙছে লালগোলার ময়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে যে এলাকায় ভাঙন দেখা গিয়েছিল তার ঠিক পাশেই সাধকপাড়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তলিয়ে গিয়েছে প্রায় ৭ বিঘা জমি। জলের ধাক্কায় প্রায় ১২০ মিটার এলাকা জুড়ে বাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে আর মাত্র ৩০০ মিটার এগোলেই পদ্মা গ্রাস করবে একটা আস্ত জনপদ। শুধু তাই নয় পদ্মার গ্রাসে চলে যেতে পারে লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্য সড়কও। আর এরকমটা হলে বিপন্ন হবে কলকাতা-সহ রাজ্যের বেশ কিছু জেলা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:২০
Share:

ময়ায় ভয়াবহ ভাঙন। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বৃহস্পতিবার রাত থেকে পদ্মা পাড় ভাঙছে লালগোলার ময়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে যে এলাকায় ভাঙন দেখা গিয়েছিল তার ঠিক পাশেই সাধকপাড়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তলিয়ে গিয়েছে প্রায় ৭ বিঘা জমি। জলের ধাক্কায় প্রায় ১২০ মিটার এলাকা জুড়ে বাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে আর মাত্র ৩০০ মিটার এগোলেই পদ্মা গ্রাস করবে একটা আস্ত জনপদ। শুধু তাই নয় পদ্মার গ্রাসে চলে যেতে পারে লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্য সড়কও। আর এরকমটা হলে বিপন্ন হবে কলকাতা-সহ রাজ্যের বেশ কিছু জেলা।

Advertisement

কারণ ময়া-বড়জুমলা থেকে পদ্মা আর ভাগীরথীর দূরত্ব বড়জোর চার কিলোমিটার। মাঝখানে এই রাজ্য সড়ক। পদ্মা এই দূরত্বটুকু পার হয়ে গেলেই এক হয়ে যেতে গঙ্গা-পদ্মা। আশঙ্কা করছেন এলাকার বাসিন্দারা।

এ দিকে পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা দিন গুনছেন শেষ মুহূর্তের। ইতিমধ্যেই ছ’টি পরিবার জেরাই সরে গিয়েছেন অন্যত্র। সমানেই চলছে পুরনো বাসস্থান থেকে ইট,কাঠ খুলে নেওয়ার কাজ। ভাঙনের খবর পেয়ে শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ এলাকা এসেছিলেন লালগোলার বিডিও স্বপ্নজিত্‌ সাহা। গ্রামবাসীরা তাঁকে দু’ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখেন। অভিযোগ, ২০১২ সাল থেকে পদ্মার ভাঙন চলছে ময়ায়। গতবারও প্রবল ভাঙনের কবলে প্রায় ৭০টি বাড়ি ধ্বসে পড়ে। তখনও প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছিল ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারই জেরে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে।

Advertisement

কিন্তু অসময়ে কেন এই ভাঙন? রঘুনাথগঞ্জ ভাঙন প্রতিরোধ দফতরের এক বাস্তুকারের মতে, বাম পাড়ে চর পড়ছে, তাই ডান পাড় ভাঙছে। পাড়ের জমির পলিস্তর লক্ষ্য করলেই দেখা যায় উপরের দু’মিটার কাদামাটির স্তর। এই স্তর যথেষ্ট জমাটবদ্ধ। কিন্তু এর নীচেই রয়েছে সাদা বালির স্তর। এই স্তর খুবই ভঙ্গুর। বর্ষায় জলের গতিতে এই বালির স্তর ক্ষয়ে গিয়ে নদীর পাড় ভাঙে। বর্ষায় ভরা নদীর প্রচুর জল পাড়ের বালির মধ্যে ঢুকে থাকে। আবার শীতের সময় জল কমতে শুরু করলে সেই জল নদীতে ফিরে আসে। ফলে জলের সঙ্গে তখন পাড়ের বালি সরে গিয়ে গহ্বরের সৃষ্টি হয় এবং পাড় ভাঙতে শুরু করে। লালগোলার ময়ায় ঠিক এমনটাই ঘটেছে। ফলে ভরা শীতেও ভাঙন দেখা দিচ্ছে। প্রায় একই কথা বলেছেন রানাঘাটের সেচ আধিকারিক প্রণব সামন্তও। সান্যালচরের ভাঙন নিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণত বর্ষার সময়ে ভাঙন হয়। তবে, অনেক সময় নদীর জল নামতে থাকলেও ভাঙন হতে পারে। ওখানে কী কারণে ভাঙন হয়েছে। সেটা সমীক্ষা করে দেখা হবে।”

সোমবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল ভাঙনের ভয়ানক ছবি। পারুন্নেসা বেওয়ার রান্না ঘরের দাওয়ায় এসে ছোবল মারছে পদ্মা। গত ১৪ বছরে চারবার আশ্রয় পাল্টাতে হয়েছে তাঁকে। এখন তিনি কুঁড়ে ঘরের চাল থেকে টালি, দরমার বেড়া খুলছেন নিজেই।

কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবেন? জানেন না প্রৌঢ়া। পারুন্নেসার নিজের পরিবারের ১২ বিঘা ফসলি জমি ছিল এক সময়। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪ বছরে সবটাই গিয়েছে সর্বনাশী পদ্মার গ্রাসে। তিন ছেলে, চার মেয়ে, শ্বশুর, নাতি মিলিয়ে ১৮ জনের সংসার। এক সময় সম্পন্ন কৃষিজীবী পরিবারটি আজ ভূমিহীন। রাজমিস্ত্রির জোগাড়েরর কাজই তাঁদের পেশা। পারুন্নেসা বলেন, “আমার স্বামী আট বছর আগে মারা গিয়েছেন। বৃদ্ধ শ্বশুর রয়েছেন। যিনি দৈনিক পাঁচ-সাতজন খেত মজুর খাটাতেন, সেই তিনিই আজ খেত মজুর।”

ময়া পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা মুস্তাকিম শেখের ছেলে আলমগীর বলেন, “আমাদের দেড় বিঘা জমি চোখের সামনে পদ্মায় তলিয়ে গেল। আমরা বড়লোক নই। কিন্তু আমাদের তিন বিঘা জমি থেকে তিন মাসের খোরাকি জুটত। সেটুকুও শেষ হয়ে আমরা এখন ভিখারি।”

আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে গোটা ময়া গ্রাম পঞ্চায়েতকে। কখন কার বাড়ি পদ্মার গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়!

লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাধিপতি সুজাউদ্দিন বলেন, “এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধের জন্য বোল্ডার দিয়ে পদ্মা পাড় বাঁধানো হয়েছিল। কিন্তু তা যথাযথ হয়নি। ফলে গত দু’বছর ধরে ময়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ’কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এই ভাঙনদ্রুত গতিতে এগোচ্ছে রাজ্যসড়কের দিকে। এমনটা সত্যিই ঘটলে পদ্মা ও ভাগীরথী একাকার হয়ে যাবে। বিপন্ন হবে দক্ষিণের জেলাগুলি।”

লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী দীপশিখা হালদার বলেন, “আমরা সবাই বিপদের মধ্যে রয়েছি। পদ্মা-ভাগীরথী একাকার হয়ে গেলে যে বিপদের মুখে এ রাজ্য পড়বে তা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। ফলে এই ভাঙন প্রতিরোধে যুদ্ধকালীন তত্‌পরতা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রর সংশ্লীষ্ট সব দফতরকে জানিয়েছি। তাররপরেও ঘুম ভাঙেনি তাঁদের। এরপর ঘুম ভাঙলে হয়ত করার কিছু থাকবে না। শুধু আফশোস করতে হবে।”

রাজ্য সেচ দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমরা লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতি ও মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ময়া এলাকায় পদ্মা-ভাঙন প্রতিরোধ নিয়ে আবেদন পেয়েছি। আবেদন-সহ গোটা ঘটনাটি আমরা জানিয়েছি পটনার গঙ্গাভাঙন প্রতিরোধ গবেষণাকেন্দ্রকে। সেখান থেকে যেমন নির্দেশ আসবে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে উত্‌কণ্ঠা কমছে না এলাকার বাসিন্দাদের। কারণ ভাঙনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়। গত শুক্রবার বিডিওকে ঘিরে তাঁদের বিক্ষোভে স্পষ্ট হয়েছে সে কথা। তাঁদের ক্ষোভ গত বছর ভাঙন কবলিতদের উদ্ধারের জন্য প্রশাসন বেশ কয়েকটি ট্রাক্টরকে মালপত্র বহনে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু তার ভাড়া দিতে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদেরই। সে দিন বিক্ষোভের মুখে বিডিও বলেন, “কয়েকটি পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় সরানো হয়েছে। রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন