সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবে যায় চরের গ্রাম। একঘেঁয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে একটা, দুটো করে জ্বলে ওঠে হিসেবি কুপি। টিমটিমে সেই আলোর সামনে দুলে দুলে পড়তে থাকে সাবিনা খাতুন, সেলিম শেখ, বাবলু মণ্ডলরা। সকালে খেত কিংবা গেরস্থালির কাজ, দুপুরে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে ভাল করে পড়ার সময় বলতে তো এটাই। তবুও বেশি রাত জেগে পড়াশোনা করা যায় না। কেরোসিন বাড়ন্ত। তাই অপেক্ষা করতে হয় সূর্যোদয়ের। তারপর খুব ভোরে উঠে ফের কিছুক্ষণ পড়াশোনা। ডোমকল ও তেহট্টের সীমান্তের বেশিরভাগ গ্রাম কিংবা চরের পড়ুয়াদের রোজনামচা এমনটাই। তারপরেও নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, মাধ্যমিকে সফল হয়েছে ওরা।
সীমান্তের সাগরপাড়া হাই স্কুল ও কাতলামারি হাই স্কুল থেকে এবছর মাধ্যমিকে পাশ করেছে প্রায় ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। ওই পড়ুয়াদের সিংহভাগই সীমান্ত কিংবা চর এলাকার। শুধু পাশ করাই নয়, ভাল রেজাল্টও করেছে তাদের অনেকে। কাতলামারি স্কুলের পিঙ্কি ঘোষ যেমন দীর্ঘ এই লড়াইয়ের ফলও পেয়েছে। মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৩০। অন্য দিকে অভাবের কাছে হেরে যায়নি অদম্য জেদ। ৬৪০ নম্বর পেয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে জলঙ্গি হাই স্কুলের ছাত্র আশিকুর রহমানও। সীমান্তের নবীপুর সরলাবালা স্কুল থেকে এবার ১৮০ জনের মধ্যে ১৬৪ জন পাশ করেছে। কাতলামারি হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, “সীমান্তের গ্রামগুলোতে দারিদ্র ও পরিকাঠামোগত হাজারও সমস্যা রয়েছে। রয়েছে অন্ধকার জগতের হাতছানিও। তারপরেও সীমান্তের ওই গ্রাম কিংবা চরের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিকে বেশ ভাল রেজাল্ট করছে। এর পিছনে শিক্ষকদেরও যেমন একটা ভূমিকা রয়েছে তেমনই অভিভাবকেরাও আগের থেকে এখন অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে পড়ুয়াদের হার না মানা মনোভাব। এই সবকিছুরই মিলিত ফল এখন মিলছে।”
চরের সমস্যা কিছুটা হলেও টের পাওয়া যায় জলঙ্গির কাকমারি চরের রুবি খাতুনের কথাতেও, “আমাদের এই এলাকায় যারা আসেনি তারা কিছুতেই বুঝতে পারবে না আমরা কীভাবে পড়াশোনা করি। গ্রাম থেকে আমাদের স্কুলের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। সাইকেল একটা আছে ঠিকই। কিন্তু বর্ষার সময় জল আর অন্য সময়ে বালির মধ্যে দিয়ে সে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। রাতে ভরসা কুপির আলো। তারপরেও প্রতি হপ্তায় কেরোসিনটাও ঠিকমতো মেলে না। আর অভাব তো আমাদের নিত্যসঙ্গী।” এত কিছুর পরেও এবছর মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে রুবি। তাঁর স্বপ্ন নিজে পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারের শ্রী ফেরানো। সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা জলঙ্গির বাবলু মণ্ডল, সেলিম শেখ কিংবা হোগলবেড়িয়ার চর মেঘনার মৌসুমী মণ্ডল, আরতি মণ্ডল, তাপসী বিশ্বাসরাও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে। তাদের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে।
কী সেই স্বপ্ন? সীমান্তের ওই পড়ুয়াদের কথায়, “সেই ছোট থেকে দেখে আসছি সংসারের অভাব। আমাদের বাবা-মায়েরাও সেভাবে লেখাপড়া জানেন না। গ্রামেও প্রায় কিছুই নেই। তাই আমাদের একটাই স্বপ্ন এই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়া।” কথাটা যে শুধু কথার কথা নয় সেটা স্পষ্ট করে দিলেন কেচুয়াডাঙা বিধানচন্দ্র বিদ্যানিকেতনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক উদয় সিহি। উদয়বাবু বলছেন, “সীমান্ত এলাকায় পদে পদে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। সমস্যাও রয়েছে অনেক। সেসবের কাছে হার না মেনে লড়াই করে চলেছে এই এলাকার পড়ুয়ারা। আর সেই লড়াইয়ের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ওরা পড়াশোনাটাকেই বেছে নিয়েছে। এটা কিন্তু সত্যিই প্রশংসা করার মতো।”
সীমান্তের স্কুল কেচুয়াডাঙা থেকে এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ১১৭ জন। তাদের মেধ্যো পাশ করেছে ১০৮ জন। সর্বোচ্চ ৬৩৬ পেয়েছে আরবপুর গ্রামের শোভন স্বর্ণকার। পেশায় দিনমজুর শোভনের বাবা কার্তিকচন্দ্র স্বর্ণকার বলছেন, “অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ওর লেখাপড়ার জন্য সেভাবে বইপত্র কিংবা টিউশন কোনও ব্যবস্থাই করতে পারিনি। শোভন বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু কীভাবে যে কী হবে বুঝতে পারছি না।” তবে শোভন কিন্তু আত্মবিশ্বাসী, “বাড়ির অবস্থা আমিও জানি। কিন্তু এখানে থেমে গেলেও তো চলবে না। স্বপ্নপূরণের পথ যে এখনও অনেকটাই বাকি। নিজে কিছু একটা না করতে পারলে পরিবারের পাশে দাঁড়াব কী করে? যত কষ্টই হোক, আমাকে এগোতেই হবে।”
তবে শোভনরা এখন আর একা নয়। সীমান্তের স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, শোভনদের মতো পড়ুয়াদের সংখ্যা এখন দিন দিন বেড়েই চলেছে। অদম্য জেদ আর ইচ্ছেশক্তির জোরে ওরা এগিয়ে চলেছে। আর এখান থেকেই শোভনদের সামনে রেখে শুধু তাদের পরিবার নয়, স্বপ্ন দেখে গোটা গ্রাম। চর মেঘনার চম্পা মাহাতোর কথাই ধরা যাক। চম্পা একসময় বহু কষ্ট করে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর সেখানেই পড়াশোনার ইতি না টেনে সে কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছে। তার বোন ইতিও এখন কলেজ পড়ুয়া। চম্পার কথায়, “আমাদের সময়টা আরও কঠিন ছিল। গোটা গ্রাম খুঁজে হাতেগোনা কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর দেখা মিলত। তবে সেই সংখ্যাটা এখন অনেক বেড়েছে। অনেকে স্বনির্ভর হয়েছে। সব থেকে বড় কথা গ্রামের মানুষও এখন বুঝতে পেরেছেন যে, এই অভাব, সীমান্তের সমস্যা সবকিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ পড়াশোনা।”
হোগলবেড়িয়া সীমান্তের বাসুদেব ঘোষ যেমন বলছেন, “একটা সময় আমাদেরও মনে হত গরিবের সংসারে পড়াশোনাটা বিলাসিতা। কিন্তু এখন বুঝতে পারি আমাদের সে ভাবনা ভুল ছিল। একমাত্র পড়াশোনাই পারে সব সমস্যার সমাধান করতে।”
সন্ধ্যর পরে দাদা-দিদিদের মতো কুপিটাকে আরও একটু কাছে টেনে নিয়ে দুলে দুলে সুর করে পড়তে থাকে আকবর, মিহির, সেলিম, রুকসানারাও। রাতের সীমান্তে সেই পড়ার আওয়াজ শোনা যায় বহু দূর থেকে। সম্মিলিত ওই গলার স্বরই যেন চরের হৃদস্পন্দন। এগিয়ে চলার অঙ্গীকার।