‘মাধবীদি’র হাত ধরে পাল্টা হাওয়া মাধুনিয়ায়

সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কের প্রহর গুনতেন মাধুনিয়া গ্রামের বহু মহিলা। কারণ রাত আর একটু গভীর হলেই টলমল পায়ে বাড়ি ফিরবেন বাড়ির কর্তারা। তারপর সারাদিনের রোজগার মদের পিছনে উড়িয়ে বাড়িতে এসে পাড়া মাথায় করবেন তাঁরা। প্রতিবাদ করলেই গালাগালি, মারধর, রক্তারক্তি।

Advertisement

কৌশিক সাহা

কান্দি শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৪ ০০:২৫
Share:

সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কের প্রহর গুনতেন মাধুনিয়া গ্রামের বহু মহিলা। কারণ রাত আর একটু গভীর হলেই টলমল পায়ে বাড়ি ফিরবেন বাড়ির কর্তারা। তারপর সারাদিনের রোজগার মদের পিছনে উড়িয়ে বাড়িতে এসে পাড়া মাথায় করবেন তাঁরা। প্রতিবাদ করলেই গালাগালি, মারধর, রক্তারক্তি। নিত্যদিন মার খেতে খেতে একদিন ওই মহিলারা সার বুঝেছিলেন, যে গণ্ডগোলটা আসলে গোড়াতেই। কান্দির পথ চলতি মানুষ সেদিনের দৃশ্যটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। গ্রামের জনাকয়েক বধূ একজোট হয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন এলাকার অন্তত ১২টি চোলাইয়ের ঠেক।

Advertisement

গল্পটা কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি। স্বামীদের নির্যাতনের মোকাবিলা করতে তাঁরা স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন। এবং শেষপর্যন্ত তা হয়েওছেন। একজন, দু’জন নয়, কান্দির মাধুনিয়া গ্রামের মাধবী হাজরার হাত ধরে কান্দি ব্লকের অন্তত সাড়ে তিন হাজার মহিলা এখন স্বনির্ভর। আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক নানা সংস্কারের কাজেও হাত লাগিয়েছেন তাঁরা। শুরুতে প্রশাসনের কর্তারা তেমন ভাবে পাত্তা না দিলেও এখন অবশ্য তাঁদেরই অনেকেই প্রশংসা করছেন। কান্দির ওই ‘সাধারণ মেয়েরা’ জানাচ্ছেন, মাধবীদি না থাকলে এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না।

মাধবীদি মানে মাধবী হাজরা। মাধুনিয়া গ্রামে স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর এক চিলতে সংসার। স্বামী সাক্ষীগোপাল পেশায় রাজমিস্ত্রি। ছেলে সূর্যগোপাল এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে সাথী ইংরেজিতে এম এ পড়ছেন। মাধবীদেবী বলছেন, “আমি নিজে উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর লেখাপড়াটা করতে পারিনি। ১৯৯৯ সালে এখানে আসার পর গ্রামের অবস্থা দেখে চমকে গিয়েছিলাম।”

Advertisement

তিনি জানান, গ্রামে শিক্ষার হার ছিল অত্যন্ত কম। সন্ধের পরেই মদ্যপরা বাড়িতে ফিরে রীতিমতো তাণ্ডব চালাত। অসহায়ের মতো পড়ে পড়ে মার খেতেন বাড়ির মেয়েরা।

এরপরেই পথে নামেন মাধবীদেবী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাছে জানতে চান, কারা মদের ঠেকের পক্ষে আর কারা নয়। বলাই বাহুল্য, সব মহিলারাই ছিলেন মদের বিপক্ষে। তারপর শুরু হয় সই সংগ্রহ। এগিয়ে আসেন অনেক পুরুষও। ২০০৫ সালে শুরু হয় অভিযান। মাধবীদেবীর নেতৃত্বে অন্তত শ’ দেড়েক মহিলা এলাকার চোলাইয়ের ঠেক ভেঙে দেন। মাধবীদেবী বলছেন, “এই ধাক্কাটার খুব দরকার ছিল। পরে অবশ্য পুলিশও সক্রিয় হয়।”

এখান থেকেই কার্যত পথচলা শুরু করেন মাধবীদেবী। তিনি বলছেন, “ঠেক তো ভেঙে দেওয়া গেল। কিন্তু মহিলারা যাতে বাড়িতে যোগ্য মর্যাদা পান সেটার জন্যও কিছু করার দরকার ছিল। আর তখনই মাথায় আসে স্বনির্ভর গোষ্ঠী করার কথা। এলাকার মহিলাদের সে কথা বলতে তাঁরাও রাজি হয়ে যান। ব্যাস, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।”

কান্দি ব্লকে এখন সেই গোষ্ঠীর সংখ্যা সাড়ে তিনশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। ওই সব গোষ্ঠীদের এক জায়গায় করে মাধবীদেবী তৈরি করেছেন মহিলা উন্নয়ন সমিতিও।

স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এক মহিলা বলছেন, “রোজ রাতে মদ্যপ স্বামীর মার খেতে খেতে একটা সময় মনে হয়েছিল এর থেকে মরে যাওয়া ভাল। তারপরে আমরা বেশ কয়েকজন মহিলা একত্রিত হয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করি।” গোষ্ঠীর আর এক মহিলার কথায়, “স্বামীর আয়ের উপর ভরসা না করে আমরা নিজেরাই কিছু কিছু কাজ করতে শুরু করি। আমাদের দেখে স্বামীরাও তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আমরা ভাল আছি।” ওই মহিলার স্বামী বলছেন, “স্ত্রীর জন্যই আমি সুস্থ জীবনে ফিরতে পেরেছি। অতীতের কথা মনে পড়লে নিজেরই এখন লজ্জা লাগে।”

যশোহরি আনোখা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তথা ব্লক তৃণমূলের নেতা ধনঞ্জয় ঘোষ বলছেন, “গ্রামের শ্রী ফেরানোর ক্ষেত্রে মাধবীদেবীর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে করে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে উনি প্রায়ই গ্রাম পঞ্চায়েতে আসতেন। নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন গ্রাম সংসদের সভাতেও। সত্যি কথা বলতে, তাঁর জন্যই গ্রামে মদের ঠেকের রমরমা অনেক কমে গিয়েছে।” কান্দির বিডিও সুরজিৎ রায় বলেন, “ওই মহিলারা একজোট হয়ে যা করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন