অনার্য অস্মিতাকে আনন্দ-অর্ঘ্য

এই বাংলা আসলে মান্য ব্যাকরণের নিগড়ে বাঁধা অনড় কিছু শব্দসমষ্টি নয়। বহতা সুবর্ণরেখা নদীর মতো বহু সংস্কৃতির ধারায় পুষ্ট সে।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৪৩
Share:

নলিনী বেরাকে সম্মাননা কৃষ্ণা বসুর। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

দুর্দিনেও বাংলা ভাষার আত্মবিশ্বাসকে স্বীকৃতি। শনিবার সন্ধ্যায় ১৪২৫ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানের সারাৎসার এটাই।

Advertisement

‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ বইয়ের জন্য লেখক নলিনী বেরার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু জানালেন, ‘‘আজ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ঘরে ফিরে যাব। যে সংস্কৃতি বাঙালির গর্ব, সেখানে আজও ভাটা পড়েনি। আমাদের সৃজনশীল কাজ ও মননশীলতা আজও অক্ষুণ্ণ।’’

এই বাংলা আসলে মান্য ব্যাকরণের নিগড়ে বাঁধা অনড় কিছু শব্দসমষ্টি নয়। বহতা সুবর্ণরেখা নদীর মতো বহু সংস্কৃতির ধারায় পুষ্ট সে। লেখক তাঁদের সুবর্ণরেখা অঞ্চলের তেলি, সদগোপ, করণ, কৈবর্ত, খন্ডায়েৎ-অধ্যুষিত জনপদের কথা বলছিলেন, ‘‘হাফ ওড়িয়া, হাফ বাংলা হাটুয়া ভাষা। মান্য বাংলাটাই সেখানে দিকু বা বিদেশিদের ভাষা।’’

Advertisement

ভাষার জোর এই আনাগোনার বহতা সংস্কৃতিতেই। উপন্যাসের ছোট্ট নায়ক এক দিন গ্রামের মাঝি হংসী নাউড়িয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাথায় জল ছিটিয়ে ওঁ গঙ্গা ওঁ গঙ্গা বলেন। ওঁ সুবর্ণরেখা তো বলেন না।’ তথাকথিত অশিক্ষিত সেই গ্রাম্য মাঝির উত্তর ছিল, ‘সুবু নদী গঙ্গা, সুবু নদীর জল গঙ্গাজল।’ আজ দেশ যদি ওই উপলব্ধিতে পৌঁছত যে শুধু গোমুখ হিমবাহ থেকে হরিদ্বার, কানপুর, কলকাতা ছুঁয়ে পৌঁছনো নদীটিই নয়, এই ভারতের সব নদীই পুণ্যতোয়া গঙ্গা...! যাক, বাস্তব জীবন থেকে সাহিত্য সব সময়েই কয়েকশো মাইল এগিয়ে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সুবর্ণরেখার ধারে সেই নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনেও যে নীরবে কত ভাষার স্রোত মিশে গিয়েছিল! নলিনীবাবু জানালেন, গ্রামে ছেলেবেলার জীবনে তাঁর প্রথম সাহিত্যপাঠ বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’। সদ্যবিবাহিত এক দাদা এক দিন কয়েক আঁটি কলমি শাক আর ‘কামসূত্র’ নিয়ে ঘরে ফিরলেন। তার পর সারা গ্রামে সেই বই নিয়ে কাড়াকাড়ি, গুঞ্জন। একে একে জীবনে এল পি কে দে সরকারের ইংরেজি গ্রামার ও ট্রানস্লেশন। পাঠ্য বইয়ে মিশে গেল আরও নানা ঝঙ্কার, ‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি।’ ঐতিহ্য তো ভাষার এই বহুত্ববাদই! আজ যাঁরা কথায় কথায় সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যের দোহাই দেন, তাঁরা ভুলে গিয়েছেন, কালিদাস, ভবভূতির নাটকেও কত ভাষা মিশে গিয়েছিল। নায়ক-নায়িকারা যদি বলতেন সংস্কৃত, প্রজাবর্গ প্রাকৃত। মানপত্র সে দিকে ইঙ্গিত করেই জানিয়েছে, ‘যে নৈরাশ্যের জগদ্দল পাথরে অনার্য ভারতবর্ষের বুক চাপা পড়ে আছে, সেই পাথর সরিয়ে ভারতবর্ষকে পুনরাবিষ্কার করার তাগিদ আপনার মননে।’ মানপত্রে উল্লিখিত এই

‘অনার্য’ শব্দটিতেও কি নেই ভাষার দ্যোতনা? আদিতে আর্য-অনার্য তো কখনওই নৃতাত্ত্বিক বা গোষ্ঠীগত বিভাজন ছিল না। যাঁরা সংস্কৃত বলতে পারেন, তাঁরা আর্য। যাঁরা পারেন না, অনার্য। কৃষ্ণা বসুর পৌরোহিত্যে লেখকের অভিভাষণ, মানপত্রের শব্দচয়ন সব যেন সেই ধ্রুপদী ঐতিহ্যের দিকেই নির্দেশ করল।
সেই ঐতিহ্যের স্রোত বেয়েই লেখক জানালেন, ‘‘এই পুরস্কারের মধ্য দিয়ে আমারই চর্চিত সমস্ত অন্ত্যজ, অপাংক্তেয় মানুষদের জয়যুক্ত করা হল।’’ তাঁর গ্রামের সাঁওতাল মেজদির কথা উঠে এল স্মৃতিচারণে। তাঁর খালি পায়ের কষ্ট দেখে এক জোড়া চটি কিনে দিয়েছিলেন লেখক। অনেক দিন পরে দিদির পুঁটলি থেকে বেরোল সেই চটি। দিদির প্রশ্ন, ‘‘তোর দেওয়া চটিজুতো আমি কি পায়ে দিতে পারি ভাই?’’ যে ভাষার কবি এক দিন ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য’ উচ্চারণ করেছিলেন, সেই ভাষার সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত লেখক জানালেন, ‘‘এই আনন্দ পুরস্কার সাঁওতাল মেজদির মতো সমস্ত অনার্য রমণীকে উৎসর্গ করলাম।’’

এ ভাবেই প্রদীপ্ত হল পুরস্কারসন্ধ্যা। ঐতিহ্য আর শিষ্ট ভাষা-হাটুরে ভাষার বহু সংস্কৃতির মিলনে। নিম্নবর্গের অচেনা, অজানা, ‘অশিক্ষিত’ সাঁওতাল রমণীকে নিয়ে স্মৃতিচারণে সন্দীপ্ত হল বাংলা ভাষার সাহিত্যসন্ধ্যা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন