মাটি চাপালেই সোনার আঁশ কালচে

নাম স্বর্ণতন্তু। কিন্তু সোনার রং কই। পচানোয় হেলাফেলা করায় এই রাজ্যে পাটের আঁশের মান অতি নিম্ন। উদাসীনতা কাটিয়ে সতর্কতার সঙ্গে কতগুলো ব্যবস্থা নিলে কিন্তু উন্নত গুণমানের পাটের আঁশ পাওয়া সম্ভব।

Advertisement

কৌশিক ব্রহ্মচারী

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০২:১৩
Share:

এই ভাবেই পাটে মাটি জাগ দেন চাষিরা। যা বারণ করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। করিমপুরে ছবিটি তুলেছেন কল্লোল প্রামাণিক।

নাম স্বর্ণতন্তু। কিন্তু সোনার রং কই। পচানোয় হেলাফেলা করায় এই রাজ্যে পাটের আঁশের মান অতি নিম্ন। উদাসীনতা কাটিয়ে সতর্কতার সঙ্গে কতগুলো ব্যবস্থা নিলে কিন্তু উন্নত গুণমানের পাটের আঁশ পাওয়া সম্ভব।

Advertisement

পাট কাটার উপযুক্ত বয়স হল ১২০-১৩৫ দিন। তবে, জমিতে পাট কাটার পর ধান লাগাতে হলে ১০০ দিনেও কাটা যায়।

কাটার পরে পাট গাছ ছোট-ছোট আঁটিতে ( ৭৫-৮০টা গাছের) বেঁধে মাটিতেই ফেলে রাখুন তিন-চার দিন। ঝরে পড়া পাতার সঙ্গে বিঘা প্রতি কমবেশি ২-৩ কেজি নাইট্রোজেন, ১ কেজি ফসফেট ও ২ কেজি পটাশ যোগ করুন মাটিতে। যা কাজে আসবে পরের বারের চাষের সময়।

Advertisement

প্রতি আঁটিতে দু’-তিনটে ধঞ্চে গাছ ঢুকিয়ে দিলে পচন ভাল হয়। সেক্ষেত্রে পাটখেতের চার ধারে ধঞ্চের সারি বুনে রাখা দরকার আগে থেকে। আসলে ধঞ্চে আগে পচে গিয়ে জলে পচনশীল জীবাণুর সংখ্যা বাড়ায়। যা পরে দ্রুত পাট পচাতে সাহায্য করে।

পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হল মিঠাজলের ব্যবহার। ধীর বেগে বয়ে যাওয়া মিঠা জলে (কখনও নোনা নয়) পাট জাগ দিন। বর্ষার আগে জলাশয়ের পাঁক পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। বদ্ধ জলাশয় হলেও পচানো যাবে। তবে সেক্ষেত্রে একই জলে তিন বারের বেশি পাট পচানো যাবে না। খেয়ালে রাখতে হবে, এক ভাগ পাটের জন্য কম করে ২০ ভাগ জল যেন থাকে জলাশয়ে।

জাগের উপরটা কচুরিপানা বা ওই জাতীয় কোনও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে ভাল ভাবে ঢেকে দিন। তারপর পাথর, ইট, তাল বা নারকেল গাছ, পুরনো কাঠের গুঁড়ি দিয়ে এমন ভাবে চাপা দিন, যাতে জাগ সহজে জলের উপর ভেসে না ওঠে বা জলের তলায় মাটিতে ঠেকে না যায়। জাগ চাপা দেওয়ার জন্য কখনওই কলাগাছ বা মাটি ব্যবহার করবেন না। যদিও আমাদের রাজ্যে চাষিরা এটাই করে থাকেন। মাটি যদি ব্যবহার করতেই হয়, তা হলে পলিথিনের মধ্যে রেখে মুখ বাঁধতে হবে ভাল ভাবে। আসলে কলাগাছ বা মাটি ব্যবহার করলে পাটের রং কালো হয়ে যায়।

শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে জাগ গিলে ১০-১৫ দিনে পাটের আঁশ ছাড়ানো যেতে পারে। আশ্বিন-কার্তিকে দিলে তাপমাত্রা কমতে থাকার জন্য সময় লেগে যায় ২০-২৫ দিন।

যথাসম্ভব পরিষ্কার জলে পাট ধুতে হবে। মাটিতে বা রাস্তায় ফেলে শোকানোটা ঠিক নয়। বাঁশ টাঙিয়ে ভারা বা ভেড়ি বািনয়ে তবেই শুকোন স্বর্ণতন্তুকে।

• জাগ দেওয়ার জন্য কলাগাছ বা মাটি ব্যবহার করবেন না। তা করলে পাটের সোনালি রং কালো হয়ে যাবে।

• মাটি যদি ব্যবহার করতেই হয়, তা হলে পলিথিনের মধ্যে রেখে মুখ বাঁধতে হবে ভাল ভাবে।

• কচুরিপানা বা জলজ উদ্ভিদ দিয়ে ঢাকলে সবচেয়ে ভাল। তারপর পাথর, ইট, নারকেল গাছ, পুরনো গুঁড়ি দিয়ে এমন ভাবে চাপা দিন যাতে জাগ জলের উপর ভেসে না ওঠে বা মাটিতে ঠেকে না যায়।

আঁশ ছাড়ানোর সময় একটু সচেতন থাকুন। পাট কাঠি না ভেঙে এক-একটা গোটা গাছের আঁশ আলাদা-আলাদা করে ছাড়াবার চেষ্টা করুন। দাম পেতে খেয়াল রাখবেন, গোটা পাটের দৈর্ঘ্য যেন পাঁচ হাতের মতো হয়।

পাট পচানোর ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জল ও সময়ের অভাব হলে ব্যবহার করতে পারেন পাট ছাড়ানোর যন্ত্র জুট রিবনার। এর সাহায্যে পাট গাছের ছাল ছাড়িয়ে ছোট-ছোট আঁটি বেঁধে নিয়ন্ত্রিত ভাবে পাট পচিয়ে পরিষ্কার জলে ধুয়ে-শুকিয়ে নেওয়া সম্ভব।

পাটের গুণমান বিচারে অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হল গোড়াছালের (বার্ক রুট) উপস্থিতি। ঠিক ভাবে না পচলে গোড়াছাল থেকে যায় বেশি মাত্রায়। কেয়োলিন পাউডার মিশ্রিত এক ধরনের ছত্রাক (অ্যাসপারজিলাস স্পিসিস) বা ফাঙ্গাল কালচার ব্যবহার করা যেতে পারে এই সমস্যা দূর করতে। এক প্যাকেট (৫০০ গ্রাম) ছত্রাক পাউডার দিয়ে দুই থেকে আড়াই কুইন্টাল পাটের গোড়াছাল সরানো সম্ভব। পাটের অাঁশ ছাড়ানোর পর ধুয়ে নিয়ে আঁশগুলো সাজাতে হবে স্তরে স্তরে। পরিমাণ মতো জলে ছত্রাক পাউডার মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে গোড়াছালে। এরপর ত্রিপল বা বস্তা দিয়ে ঢেকে দিয়ে মাঝে-মধ্যে ভিজিয়ে স্যাঁতসেঁতে রাখতে হবে আঁশগুলোকে। দু’তিন দিনে গোড়াছাল সরে যাবে। এরপর পরিষ্কার জলে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।

পাটের প্রতি তিনশো কেজি ভেজা অাঁশে (পচানোর পর ভাল ভাবে ধুয়ে নেওয়া ও বাড়তি জল ঝরিয়ে নেওয়া) দু’কেজি ডিএপি সার ও দু’কেজি চিটেগুড় মিশ্রিত ১০০ লিটার জল ভাল ভাবে ছিটিয়ে দিয়ে দু’-তিন ঘণ্টা রেখে যদি স্বাভাবিক ভাবে শুকিয়ে নেওয়া যায়, তবে পাটের উজ্জ্বলতা বাড়ে।

সবশেষে একটা কথা, মুনাফা পেতে সস্তা প্রযুক্তির (লো কস্ট টেকনোলজি) সাহায্য নিন। ‘পাটকাঠে সারা বছরের জ্বালানি, আর তার সঙ্গে পাটের যা দাম পাই’—কৃষকের এই মানসিকতা দূর করতে হবে সবার আগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন