শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোই মূল লক্ষ্য

বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গলমহল দিয়ে শহর ঘিরেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে সেই ঋণ চুকিয়ে একাই দুশো পেরিয়েছেন এ বার। তাই ‘বাংলাকে বিশ্বসেরা’ করার দায় ও ভার দুই-ই এখন বেশি।

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস ও জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০৪:০৮
Share:

নবান্নে পৌঁছনোর পর পুলিশের ‘গার্ড অব অনার’ নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গলমহল দিয়ে শহর ঘিরেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে সেই ঋণ চুকিয়ে একাই দুশো পেরিয়েছেন এ বার। তাই ‘বাংলাকে বিশ্বসেরা’ করার দায় ও ভার দুই-ই এখন বেশি। শুক্রবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরে নবান্নে পৌঁছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, সেই ভার অনুভব করছেন তিনিও। দ্বিতীয় মেয়াদে অগ্রাধিকারের তালিকাটাও সে জন্য বদলে ফেলেছেন কিছুটা। শিল্পায়ন, আরও বেশি নগরায়ণ এবং তার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোই হতে চলেছে তাঁর মূল লক্ষ্য।

Advertisement

সরকারের অভিমুখ নিয়ে যাতে ধন্দ না-থাকে সে জন্য শুক্রবার বিকেলে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরই সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, ‘‘এ বার আমার মূল লক্ষ্য রাজ্যের যুবক-যুবতীরা। ইয়ং ব্রিগে়ডকে এগিয়ে দিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য সরকার পদক্ষেপ করবে।’’ মন্ত্রিসভায় গৃহীত প্রস্তাবেও বলা হয়েছে, ‘‘গত পাঁচ বছরে সরকার তফসিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি, সংখ্যালঘু, মহিলা, শিশুদের কল্যাণে কাজ করেছে। ঋণভারে জর্জরিত থেকেও এই কাজ করা হয়েছে। এ বার সরকারের লক্ষ্য হবে যুব সমাজের জন্য আরও কর্মসংস্থান করা। মানুষের জীবনের মান বাড়ানো।’’

তৃণমূল নেতারা এবং নবান্নের আমলারা বলছেন, অনুদান বিলিয়ে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে যা পাওয়ার তা মমতার পাওয়া হয়ে গিয়েছে। অনুদান বিলি চালিয়ে গেলেও পাঁচ বছর পরে গ্রাম-বাংলার মানুষের সমর্থনে খুব বেশি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। উল্টে দশ বছরের ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’র মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে। ফলে তখন তাঁর ‘ত্রাতা’ হয়ে দেখা দেবে সমাজের এমন অংশ খুঁজে বার করার কাজ এখন থেকেই শুরু করে দিতে হবে মমতাকে।

Advertisement

সে দিক থেকে তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানার দায় রয়েছে দিদির। এমনিতেই রাজ্যে কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না বলে অসন্তুষ্ট শিক্ষিত তরুণরা। সুতরাং শিল্প চাই। আর অনুদানের সংস্কৃতি জিইয়ে রাখতে গেলেও রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। শিল্পায়ন ছাড়া সেটা অসম্ভব।

শুধু মুখে বলা নয়, সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নতুন মন্ত্রিসভায় দফতর বণ্টন যে ভাবে করলেন, তার পদে পদে সেই ছাপ স্পষ্ট। শিল্পমহলে পরিচিত মুখ অমিত মিত্রকে রেখে দিলেন অর্থ ও শিল্প দফতরে। নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত হলেও আস্থাভাজন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিলেন আবাসন দফতরের। কারণ, নগরায়ণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবাসনে বিনিয়োগ টানা ও তার মাধ্যমে কাজের সুযোগ বাড়ানোর চাহিদা রয়েছে রাজ্যে। গুরুত্ব বাড়ল অরূপ বিশ্বাসেরও। যুবকল্যাণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন। এ বার তার সঙ্গে পূর্ত এবং সড়ককে যুক্ত করে পরিকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁকে। একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বারবার বুঝিয়ে দিলেন, ভোটে হারলেও কাজের লোক হিসেবে পরিচিত মণীশ গুপ্তের গুরুত্ব অটুট থাকছে। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে বিদ্যুৎমন্ত্রী করা হলেও ওই দফতর সংক্রান্ত কোনও পদ তৈরি করে দায়িত্ব দেওয়া হবে মণীশবাবুকে।

কিন্তু নতুন লক্ষ্যে কী ভাবে এগোবে সরকার? মমতার জবাব, ‘‘অবশ্যই শিল্প নিয়ে আমরা এগোব। প্রতি বছর আমরা শিল্প সম্মেলন করি। তার ফলে পরিবেশ তৈরি হয়। সেই কাজ চলবে।’’ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ এখনও জ্বলন্ত সমস্যা। তবে মমতা সরকারে ফেরার পর থেকেই আমলারা জানাচ্ছিলেন, কৃষক তথা জমির মালিকের স্বার্থ অটুট রেখেও জমিনীতিতে বদলের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মমতাই। এবং গত বারের মতো এ বারও ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর তাঁরই হাতে।

তবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণে এ বার বাড়তি গুরুত্ব থাকলেও গ্রামোন্নয়ন এবং পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নে যে তাঁর সমান নজর থাকবে, দফতর বণ্টনের মধ্যে দিয়ে সেই বার্তাও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দায়িত্ব গত বার ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ওই দুই দফতরে সুব্রতবাবুর কাজের সুফল যে ভোটে পাওয়া গিয়েছে তা নিয়ে তৃণমূলে দ্বিমত নেই। সুব্রতবাবুর তাই দফতর বদল হল না। তাঁকে ওই পদে রেখে উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের জন্য নিয়ে এলেন নতুন মুখ রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নে তাঁর কাজে খুশি হয়ে ওই দফতরে রেখে দেওয়া হল শান্তিরাম মাহাতোকে।

এ বার মমতার সম্ভাব্য মন্ত্রিসভা নিয়ে কার্যত ভোটের ফল ঘোষণার আগে থেকেই কৌতূহল ও জল্পনা ছিল। এ-ও মনে করা হয়েছিল, টায়ে টায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে মন্ত্রিসভা গঠন করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়বেন মমতা। শুভেন্দু অধিকারীর মতো দাপুটে নেতাকে তখন একটি দফতর দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা না-ও যেতে পারে। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ফল হয়েছে উল্টো। একাই দুশো আসন পেয়ে চাপমুক্ত ভাবে দফতর বণ্টন করতে পেরেছেন দিদি। তবে শুভেন্দুকেও হতাশ করেননি। শুভেন্দু অনুগামীদের আশামতো একাধিক দফতর না-দিলেও পরিবহণ দফতরের ভার দিয়েছেন তাঁকে।

দফতর বদল হয়নি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এবং নারদ-অভিযুক্ত ফিরহাদ হাকিমের। মলয় ঘটকের কাছে শ্রম দফতর ছিলই। গত সরকারের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য পরাস্ত হওয়ায় এ বার আইন দফতরের দায়িত্বও মলয়কে দিলেন মমতা। তবে সূত্রের মতে, উপনির্বাচনে মণীশ গুপ্তকে জিতিয়ে আনতে পারলে বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে। তখন শ্রম দফতরে আনা হতে পারে শোভনদেবকে।

তবে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ ভাবে ঘুঁটি সাজালেও মমতার চোখ থাকল ঘুরে ফিরে মূলত তিন বিষয়ে— শিল্প, নগরায়ণ এবং কর্মসংস্থান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন