দু’টিই সর্বভারতীয় বোর্ড। তবু আইসিএসই থেকে ফি-বছর অনেক ছাত্রছাত্রীই চলে যাচ্ছেন সিবিএসই-তে। এই পলায়ন-প্রবণতা রুখতে পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজার পথ নিল আইসিএসই। তাদের আশা, সিবিএসই-র ধাঁচে পাঠ্যক্রম সাজিয়ে নিতে পারলেই পড়ুয়াদের ধরে রাখা যাবে।
অর্থাৎ পড়ুয়াদের এই পলায়ন-রহস্যের চাবিকাঠি পাঠ্যক্রমের মধ্যেই আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমন ধারণা কেন?
শিক্ষা শিবির বলছে, আসলে সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলির প্রশ্নপত্র হয় মূলত সিবিএসই-র ঢঙে। তাই ওই সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সিবিএসই বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের হার বেশি। আর সেই জন্যই একাদশ শ্রেণি স্তরে ভর্তি হওয়ার সময় আইসিএসই বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের অনেকে সিবিএসই বোর্ডের অধীন স্কুলগুলির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছেন। নানান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্যের আশায় এত দিনের স্কুল ছেড়ে তাঁরা ভর্তি হচ্ছেন সিবিএসই স্কুলে। পড়ুয়াদের এই প্রবণতায় লাগাম দিতে হলে সাফল্যের রাস্তা দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর তার জন্য চাই অনুকূল পাঠ্যসূচি। যেটা দিতে পারে সিবিএসই-র পাঠ্যক্রম। সেই জন্যই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে চলতি বছর থেকেই বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে বদল আনছে আইসিএসই। তাদের পাঠ্যসূচি হবে সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন বা সিবিএসই-র ধাঁচে। প্রশ্নপত্রও হবে সিবিএসই-র আদলে।
কাউন্সিল ফর দ্য ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট এগ্জামিনেশনস বা আইসিএসই বোর্ডের সিইও জেরি অ্যারাথুন মঙ্গলবার বলেন, ‘‘চলতি বছর থেকেই আমরা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক ও জীববিদ্যার পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজছি। সিবিএসই যে-পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে, অনেকটা সেই ধাঁচেই পাঠ্যসূচি বদল করা হচ্ছে। প্রশ্নও করা হবে সিবিএসই-র মতো করেই।’’
শুধু আইসিএসই বোর্ডই যে সিবিএসই-র রাস্তা নিচ্ছে, তা নয়। অবস্থা বুঝে পাঠ্যসূচি এবং প্রশ্নের ধরন বদলের পরিকল্পনা করেছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদও। কারণ, কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশ কিছু স্কুল ইতিমধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ থেকে চলে গিয়েছে সিবিএসই বোর্ডের অধীনে। এই প্রবণতাটা বেড়েই চলেছে।
এ বার রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল সেই প্রবণতা আরও উস্কে দেবে বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা। ওটা বাংলার নিজস্ব প্রবেশিকা হওয়া সত্ত্বেও মেধা-তালিকার প্রথম দিকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পাঠ্যক্রম পড়ে আসা ছাত্রছাত্রীরা ঠাঁই বিশেষ পাননি। এমনকী উচ্চ মাধ্যমিকে যাঁরা চোখ-ধাঁধানো ফল করেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের মেধা-তালিকায় তাঁদেরও খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন পরীক্ষায় বাংলার ছাত্রছাত্রীরা এঁটে উঠতে পারছে না দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু নিজেদের রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকায় কেন তাঁদের উজ্জ্বলতর প্রতিনিধিত্ব থাকবে না, সেই প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে শিক্ষা শিবিরকে। অনেক ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবক তো বটেই, খাস কলকাতার বহু স্কুলও পড়ুয়াদের স্বার্থে আর প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার তাগিদে সিবিএসই-কে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন।
সিবিএসই এবং আইসিএসই বোর্ডের পাঠ্যসূচির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে বলে অনেকের ধারণা। এটা মোটেই ঠিক নয় বলে জানাচ্ছেন অ্যারাথুন। তাঁর ব্যাখ্যা, কাউন্সিল অব বোর্ড অব স্কুল এডুকেশন ইন্ডিয়া (সিওবিএসই বা কবসে) পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক ও জীববিদ্যার জন্য যে-পাঠ্যসূচি তৈরি করেছে, দেশের ১৭টি বোর্ড তা অনুসরণ করে। সিবিএসই এবং আইসিএসই-ও তা-ই করে আসছে। (উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদও সেই আদলে বিজ্ঞানের ওই চারটি বিষয়ে পাঠ্যসূচি তৈরি করেছে)। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে কী পড়ানো হবে আর দ্বাদশের পাঠ্যই বা কী হবে, সেই বিষয়-বিন্যাস ছিল আলাদা রকমের। ‘‘এ বার এই ব্যাপারেও সিবিএসসি-কেই অনুসরণ করবে আইসিএসই বোর্ড,’’ বলেন অ্যারাথুন। সেই সঙ্গে তাঁরা ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রি-প্রাইমারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যসূচিও বদল করছেন বলে জানান আইসিএসই-র সিইও।
পাঠ্যসূচিতে এই পরিবর্তন আনার তাগিদ তাঁরা অনুভব করলেন কেন, অ্যারাথুন সেটা গোপন করেননি। তিনি বলেন, ‘‘দশম পর্যন্ত আমাদের বোর্ডে থাকলেও একাদশে ভর্তির মুখে বহু পড়ুয়া সিবিএসই–তে চলে যাচ্ছে। সেই প্রবণতা রোধ করতেই এই পদক্ষেপ।’’ ২০১৮ সালে নতুন পাঠ্যসূচির পরীক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেবেন। তখনই বোঝা যাবে, পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের ফল কী হয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুধু সিবিএসই-কেই কেন সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অ্যারাথুন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার দায়িত্ব যাতে পৃথক কোনও বোর্ডকে দেওয়া হয়, সেই বিষয়ে আমরা কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে আবেদন করব। কারণ, অনেকেরই ধারণা, সিবিএসই যে-হেতু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন করে, তাই একাদশ শ্রেণি থেকে ওই বোর্ডে পড়াশোনা করলে বাড়তি সুবিধে মিলতে পারে।’’
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক পড়ুয়া যে নিজেদের স্কুলের উপরে ভরসা না-করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, সেটা উপলব্ধি করেছে আইসিএসই বোর্ডও। সেই সমস্যার সমাধান করতেও উদ্যোগী হয়েছে তারা। অ্যারাথুন জানান, এ বার থেকে স্কুলেই সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর ফলে পড়ুয়ারা আরও বেশি করে স্কুলমুখো হবেন বলে তাঁদের আশা।