‘নির্মল’ জেলায় এখনও দাবি শৌচাগারের

এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবু এটাই বাস্তব। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষায় শৌচাগার তৈরিতে নদিয়া দেশের মধ্যে এক নম্বর স্থান পেয়েছে। বিশ্বেও নাকি সেরা! মাস ছ’য়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জেলা সফরে গিয়ে নদিয়াকে ‘নির্মল জেলা’ বলে ঘোষণা করে প্রশংসা করেন জেলাশাসকের।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫১
Share:

এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবু এটাই বাস্তব। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষায় শৌচাগার তৈরিতে নদিয়া দেশের মধ্যে এক নম্বর স্থান পেয়েছে। বিশ্বেও নাকি সেরা! মাস ছ’য়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জেলা সফরে গিয়ে নদিয়াকে ‘নির্মল জেলা’ বলে ঘোষণা করে প্রশংসা করেন জেলাশাসকের। ২৩ জুন দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় গিয়ে তৎকালীন জেলাশাসক পিবি সালিম শৌচাগার তৈরির ‘সাফল্য’-এর জন্য পুরস্কার নিয়ে এসেছেন। তবুও ১৯ নভেম্বর বিশ্ব শৌচাগার দিবসে নদিয়ার বিষ্ণুপুরের অনেক বাসিন্দার বাড়িতে শৌচাগার না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করতে হচ্ছে।

Advertisement

কৃষ্ণনগর শহর থেকে মেরেকেটে দশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বিষ্ণুপুর। শৌচাগার নিয়ে কথা উঠতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন গ্রামের অনেক লোকজন। ইব্রাহিম শেখের স্ত্রী রিঙ্কু বিবিকে বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে কিনা, প্রশ্ন করত‌েই খানিকটা যেন অবাকই হলেন তিনি। জানালেন, বছর দেড়েক আগে প্রশাসনের তরফে শৌচাগার তৈরি করার জন্য ন’শো টাকা নেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, বাকি টাকা সরকার দেবে। বানিয়ে দ‌েওয়া হবে পাকা শৌচাগার। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাড়িতে একটা ইট পড়েনি। এখনও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তাঁদের খোলা মাঠেই যেতে হয়। রিঙ্কু বিবি কোনও বিচ্ছিন্ন চরিত্র নয়। তাঁর কথার খেই ধরলেন পড়শি মহিলা মনো বিবি। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমরা প্রশাসনের কাছে বার বার দরবার করেছি। কিন্তু কেউ কোনও কথা কানে তো‌লেনি। আজও শৌচাগার তৈরি হল না।’’ গ্রামবাসীদের দাবি, এখনও গ্রামের প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারে শৌচাগার নেই।

জেলার শৌচাগারহীন গ্রামের মানচিত্রে বিষ্ণুপুর কোনও ব্যতিক্রম নয়। ‘নির্মল’ নদিয়াতেই ন’জন পুরকর্মীর তাহেরপুর পুরসভার খাতায় পরিচয়, ‘হিউম্যান স্ক্যাভেঞ্জার।’ জেলা ‘নির্মল’ ঘোষণার পরপরই এই তথ্য সামনে এসেছিল। বস্তুত ‘নির্মল’ ঘোষণার হওয়ার পরে জেলার সব গ্রামে একশো শতাংশ শৌচাগার তৈরি হয়নি। মাসখানেক আগেই নাকাশিপাড়া ব্লকের বীরভূম গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা দাবি করেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে শৌচাগার নেই। কারও বক্তব্য ছিল, ন’শো টাকা জমা দিয়েও শৌচাগার মেলেনি। কারও বা অভিযোগ ছিল, শৌচাগার তৈরির জন্য টাকা জমা দিতে গেলেও তা নেননি পঞ্চায়েতের কোনও কর্তা।

Advertisement

বস্তুত, নির্মল জেলা ঘোষণা হওয়ার পরেও, বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকাতেই দেখা যাচ্ছে, ঢিমেতালে এখনও শৌচাগার গড়ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থাগুলি। এখনও শৌচাগার ঠিকঠাক ভাবে তৈরি হয়েছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য নিযুক্ত প্রশাসনের চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা রয়ে গিয়েছেন।

জেলার এক বিডিও বলেন, ‘‘সমস্ত বাড়িতে শৌচাগার তৈরি হয়ে গেলে, ওই কর্মীরা তো থাকতেন না। এতেই প্রমাণিত হয় জেলা নির্মল হয়েছে কাগজে-কলমে।’’ নাকাশিপাড়ার একটি পঞ্চায়েত এলাকায় ২,৮৬৫টি শৌচাগার তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এখনও অবধি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে মাত্র অর্ধেক। ওই পঞ্চায়েতের এক সদস্যের খেদ, ‘‘আমাদের পঞ্চায়েতে কাজ শুরু হয়েছিল অনেক পরে। তার উপরে কাজ চলছে শম্বুক গতিতে। এখনও পর্যন্ত হাজার দেড়েক শৌচাগার তৈরি হয়েছে।’’

অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা জেলা প্রশাসনের নির্দেশে শৌচাগারবিহীন বাড়ির তালিকা তৈরি করেন। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ প্রকাশিত ওই তালিকায় দেখা যায়, জেলার বেশ কয়েক লক্ষ পরিবারে শৌচাগার নেই। ওই বছরেরই ২ অক্টোবর জেলা প্রশাসন জেলার সমস্ত পরিবারেই শৌচাগার তৈরি করে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়।

কথা ছিল, ২০১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নদিয়ার সব ব্লক ‘নির্মল’ বলে ঘোষণা করা হবে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলের পর থেকে অক্টোবর অবধি শৌচাগার তৈরিতে প্রায় ৫ কোটি ২২ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, কাজ শেষ না হলেও পুরস্কার নেওয়ার জন্য প্রশাসন জেলাকে ‘নির্মল’ ঘোষণা করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।

সিপিএমের ভালুকা-জোয়ানিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক প্রবীর মিত্র বলেন, ‘‘আসলে পুরস্কারের লক্ষ্যে ছুটেছিল প্রশাসন। তা না হলে প্রকল্পের এই হাল হবে কেন?’’ জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, আসলে শৌচাগার তৈরির কাজে নিযুক্ত সংস্থাগুলির অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে। তাই এখনও কাজ চলছে ধীরে। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিভিন্ন মাধ্যমে জানার চেষ্টা চলছে, এখনও কোন পরিবারে শৌচাগার নেই। আমরা তাঁদের শৌচাগার বানিয়ে দিচ্ছি।’’

নদিয়ার প্রাক্তন জেলাশাসক পিবি সালিম বলেন, ‘‘ওই পরিবার শৌচাগার পায়নি কেন এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বহু পরিবারের শৌচাগার নির্মাণের কাজ চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন