ইস্কোর আধুনিকীকরণ প্রকল্প উদ্বোধনের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীকে নমস্কার কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র। ভিক্টোরিয়ায় ভেলপুরি সহযোগে আড্ডার পরের দিন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
একেই বলে বোধ হয় ভস্মে ঘি ঢালা!
যে সংস্থা কোনও দিন লাভের মুখ দেখেনি, বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে যার জন্য কোনও ক্রেতা পাওয়া যায়নি, তার প্রাণ বাঁচাতে এক সুর নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
মুখ্যমন্ত্রী যখন দাবি করছেন, ইস্কো নিয়ে সেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমল থেকে লড়ে যাচ্ছেন তিনি, তখন প্রধানমন্ত্রী ইস্কোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা প্রকাশ করেছেন। এ দিনই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সেল) জানিয়ে দিয়েছে, ইস্কোর আধুনিকীকরণে এ পর্যন্ত ঢালা ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকাই শেষ নয়। আগামী ১০ বছরে খরচ করা হবে আরও ১৭ হাজার কোটি টাকা!
কিন্তু তার পরেও এই সংস্থা লাভের মুখ দেখবে কি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ইস্পাত শিল্পের বাজার যদি সূচক হয়, তা হলে লোকসানের বহর বাড়ানো ছাড়া আর কোনও কাজেই আসবে না ইস্কো। এই কারখানা চালিয়ে যাওয়া সাদা হাতি পোষার সমতুল হবে।
এ দিন ইস্কো কারখানার নব কলেবর উদ্বোধন সেরে প্রধানমন্ত্রী বার্নপুর ছাড়ার পরেই সেলের চেয়ারম্যান সি এস বর্মা ঘোষণা করেন, আগামী ১০ বছরে সেল তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি টনে নিয়ে যাবে। সেই কারণে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা এবং ইস্কোর উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ানো হবে। সেল চেয়ারম্যানের বক্তব্য, দুর্গাপুরের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ লক্ষ টন থেকে বাড়িয়ে ৯০ লক্ষ টন করা হবে। লগ্নি হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। আর ইস্কো কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে বছরে ৫৬ লক্ষ টন ইস্পাত তৈরি করা হবে। তার জন্য বার্নপুরে আরও ১৭ হাজার কোটি টাকা ঢালা হবে।
কারখানা নতুন করে পথ চলা শুরু করার আগেই ফের বিনিয়োগের এই ঘোষণায় বিস্মিত শিল্প মহলের বড় অংশ। তাঁদের প্রশ্ন, সেলের মতো মহারত্ন কোম্পানি নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারার এই সিদ্ধান্ত নিল কেন? যেখানে দেশের বাজারে ইস্পাতের চাহিদা তেমন নেই, বিদেশের বাজারের বেশির ভাগই চিনের দখলে, তখন আধুনিকীকরণের নামে চড়া দামে ইস্পাত তৈরি করে তা কোথায় বিক্রি করবে ইস্কো?
তা না হলে সেলের লাভজনক অন্য কারখানাগুলির ঘাড়ে চেপে বসবে ইস্কো কারখানার পর্বতপ্রমাণ লোকসানের অঙ্ক। তাই এই সিদ্ধান্তের পিছনে অর্থনীতির থেকেও রাজনীতিই বেশি বলে মনে করছেন দেশের ইস্পাত মহলের অনেকে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবশ্য অন্য তত্ত্ব সাজিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গম উৎপাদন করলাম আর পড়শির বাড়িতে তা পাঠিয়ে দিয়ে তার বদলে রুটি নিয়ে এলাম, এ জমানা শেষ করতে হবে। এই দেশেই আকরিক লোহা থেকে ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তার জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতেই ৩০ কোটি টন ইস্পাত তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।’’
প্রধানমন্ত্রী জানান, এ দেশ থেকে আকরিক লোহা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে সেই আকরিক লোহায় যে ইস্পাত তৈরি হচ্ছে, তা ফিরছে আমাদের দেশে। বিশেষ করে চিন আমাদের বাজার দখল করছে। সেই কারণে চিনকে টেক্কা দিতে এ দেশেই প্রয়োজনীয় ইস্পাত তৈরির চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা ইস্কো অর্জন করতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান ইস্পাত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। যে সংস্থার ১৬ হাজার কর্মীর বেতন-পেনশনের বোঝা এখনও টানতে হচ্ছে, সেখানে সস্তার ইস্পাত তৈরি করে বাজার ধরাটা প্রায় অসম্ভব। আর সেলের মতো সংস্থা যদি এই সব কারখানা অধিগ্রহণ করে লগ্নি করে, তা হলে আদতে মহারত্ন সংস্থাটির রুগ্ণ হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
শুধুমাত্র ঝাড়খণ্ডের গুয়া, চিড়িয়ার আকরিক লোহার খনি আর চাষনালা, জিৎপুর, রামনগরের কয়লা খনির ইজারা পেতে সেল যদি এত বড় আর্থিক বোঝা কাঁধে তুলে নেয়, তা হলে আর যাই হোক অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম মানা হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, স্রেফ রাজনৈতিক লাভ তুলতেই এই বন্ধ্যা প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও লগ্নি করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
ইস্কো আধুনিকীকরণের পিছনে রাজনীতিই যে মূল, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে তার কৃতিত্ব দাবির ইঁদুর দৌড় থেকে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থন দেওয়ার পিছনে যে বেঙ্গল প্যাকেজ চেয়েছিলাম, তার অন্যতম ছিল ইস্কোর আধুনিকীকরণ।’’
আবার এ দিন প্রধানমন্ত্রী কেন এক বারও ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বা তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম করলেন না, তা নিয়ে সরব হয়েছে কংগ্রেস। তাদের বক্তব্য, প্রণববাবুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ইস্কোর আধুনিকীকরণের জন্য অর্থ মঞ্জুর করেছিল। এখন নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার কৃতিত্ব দাবি করছেন!
দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লকেট চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ আচার্য।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘কাজ করল ইউপিএ সরকার। আর মোদী ফিতে কেটে এমন ভাব করছেন যেন, বাংলার জন্য কত কিছু করলাম!’’ অন্য দিকে, প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘ইস্কোর সম্প্রসারণের কাজে জমি নিতেও বাধা দিয়েছিল তৃণমূল। এখন মোদী-মমতার বক্তৃতা ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেবে না!’’
আসলে ইস্কোর ইতিহাসই তার ঘুরে দাঁড়ানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মেনে নিচ্ছেন এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেকে। মৃতপ্রায় রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে কিছু কাল বাঁচানো গেলেও তাকে সুস্থ জীবনে ফেরানো যায় না। জাতীয়করণের পর থেকেই ইস্কোর জীবন্মৃত দশা। অতীতে টাটা, মিত্তলের মতো সংস্থাও এর ভার নিতে রাজি হয়নি। এখন আধুনিকীকরণের কোরামিন দিয়েও এই কারখানাকে বাঁচানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই যদি হয়, তা হলে করদাতাদের টাকায় এই রাজনীতি কেন, প্রশ্ন শিল্পমহলের।