Air Pollution

গাছের পাতা কালো, আ-ঢাকা ভাতও

সরকার আছে। আইন আছে। তবু কেউ নেই প্রকৃতি, পরিবেশের। মানুষের। বিষ জল, স্থল, বাতাসে।সম্প্রতি দুর্গাপুরের সগড়ভাঙা, রাতুড়িয়া, অঙ্গদপুর, বিধাননগরের নানা এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, কালো ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকেছে।

Advertisement

সুব্রত সীট ও নীলোৎপল রায়চৌধুরী

দুর্গাপুর ও রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:৫৭
Share:

দূষণের জেরে কালো ধুলোয় ঢেকেছে গাছ। মঙ্গলবার শিল্পতালুকে। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

শীতের রোদ গায়ে মাখার উপায় নেই। কারণ, দরজা-জানলা খোলা রাখলেই কালো হয়ে যায় আ-ঢাকা ভাত। পুকুরের জলে কার্বনের কালো স্তর। আশপাশের গাছপালার পাতাও কালো!— এই ‘কালো’য় ধুঁকছে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ফুসফুস। নানা এলাকার বাসিন্দার সংবাদমাধ্যমের একাংশের কাছে অভিযোগ, কলকারখানাগুলি নিয়ম না মানায় এমন দূষণ-চিত্র।

Advertisement

সম্প্রতি দুর্গাপুরের সগড়ভাঙা, রাতুড়িয়া, অঙ্গদপুর, বিধাননগরের নানা এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, কালো ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকেছে। চায়ের দোকানের আড্ডায় মশগুল যুবকদের পরামর্শ, ‘‘চশমা পরে আসবেন এখানে। না-হলে চোখে ধুলো, ছাই ঢুকবে।’’ একই ছবি রানিগঞ্জের মঙ্গলপুর শিল্পতালুক লাগোয়া বক্তারনগর, বাবুইসোল, পলাশবন, নতুন মদনপুর, চকরামবাটি, হরিশপুর, ধাণ্ডাডিহি, রনাই, জামুড়িয়ার ইকড়া-সহ নানা জায়গাতেও।

বক্তারনগরে ঘুরলে শোনা যায় ক্ষোভ আর আক্ষেপ। সেখানকার বাসিন্দা লুইচাঁদ সূত্রধর, জীবন মণ্ডলদের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের দূষণ-ভোগান্তি বহু দিনের। ২০০৩-এ মাছ চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু দূষণে সব মাছ মরে যায়। পরিস্থিতি এত দিনেও বদলায়নি!’’ পুকুর তো বটেই, সিঙ্গারণ নদেরও বড় অংশের জল আর ব্যবহার করা যায় না। তেমনই অভিজ্ঞতা ইকড়া গ্রামের তপন ঘোষ, সার্থকপুরের সোমনাথ বাউড়িদের।

Advertisement

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে শিল্পাঞ্চলের বাতাসে ভাসমান শ্বাসযোগ্য ধূলিকণা, পিএম ১০-এর (১০ মাইক্রোমিটারের ছোট আকারের ভাসমান ধূলিকণা) হার চিন্তায় রাখছে পর্ষদ কর্তাদের। দুর্গাপুরের বাতাসে গত ৪ ডিসেম্বর রাত ১০টায় এই মাত্রা ছিল, ৩৬৮.৭৬! অথচ, এর স্বাভাবিক মাত্রা ১০০ ধরা হয়। এর ফলে, ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত, হৃদ্‌রোগী এবং বয়স্ক ও শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বড়ছে বলে জানান চিকিৎসকেরা।

আসানসোল জেলা হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার শ্যামল সান্যাল বলেন, ‘‘কালো ছাইয়ে মিশে থাকে কয়লা, লোহা ও স্পঞ্জ আয়রনের গুঁড়ো। ফুসফুসে ঢুকে সেগুলো শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করে। এই ছাই জমি, জলাশয়ে মিশে চাষেরও ক্ষতি করে।’’

কিন্তু কেন এই হাল? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, দুর্গাপুর ও রানিগঞ্জের ওই এলাকাগুলিতে বহু স্পঞ্জ আয়রন, বেসরকারি ইস্পাত ও ইস্পাত অনুসারী কারখানার অধিকাংশ বিদ্যুতের খরচ বাঁচাতে দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর) চালায় না। যদিও ‘ওয়েস্টবেঙ্গল স্পঞ্জ আয়রন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শঙ্করলাল আগরওয়ালের দাবি, ‘‘অধিকাংশ কারখানাই দূযণ-বিধি মেনে চলে। দু’একটি ক্ষেত্রে হয়তো অভিযোগ ওঠে। তবে সেটাও না-হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’’

শুধু কারখানাই নয়, দুর্গাপুরের ভিতর দিয়ে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের একাংশ যাওয়ায় ও শহর জুড়ে নির্মাণকাজ চলার কারণেও এই হাল হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর একাংশের। জামুড়িয়া ও রানিগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক যথাক্রমে জাহানারা খান ও রুনু দত্তের অভিযোগ, ‘‘জেলার দূষণ নিয়ে বারবার সরব হয়েছি বিধানসভায়। কিন্তু গা করেনি সরকার।’’ পরিবেশকর্মী তথা পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পাদক কল্লোল ঘোষের দাবি, ‘‘দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র নিয়মিত চালানো হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা উচিত প্রশাসনের। জরুরি নিয়মিত বৃক্ষরোপণও।’’

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা বলেন, ‘‘নিয়মিত অভিযান হয়। তবে আরও নজরদারি দরকার। পর্ষদের লোকবল কম থাকায় সমস্যা হচ্ছে।’’ যদিও জেলাশাসক (পশ্চিম বর্ধমান) পূর্ণেন্দু মাজি বলেন, ‘‘দূষণ-বিধি ভাঙার নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই পদক্ষেপ করা হয়।’’ নিয়মিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলছে বলে জানান দুর্গাপুর পুরসভার মেয়র দিলীপ অগস্তিও। আর ‘বেঙ্গল সাবার্বান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর সাধারণ সম্পাদক প্রফুল্ল ঘোষের প্রতিক্রিয়া, ‘‘দূষণ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে জানি। মুনাফা ও পরিবেশ— দু’দিকের কথা আমাদের ভাবতে হবে।’’

স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য হাড়ে হাড়ে টের পান, পরিবেশ এখানে উপেক্ষিতই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন