এখনই ডেকে আনুন কমিশনারকে

কাউকে রেয়াত নয়, বোঝালেন জৈদী

কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানালেন, সিপি বিকেল সাড়ে তিনটেয় আসবেন। তাতে অবশ্য লাভ হল না। দ্বিগুণ কড়া গলায় নির্দেশ এল, সিপি-কে এখনই আসতে বলুন। তড়িঘড়ি হাজির হলেন রাজীব কুমার। এসে জবাবদিহি করতে হল, কলকাতা নিয়ে এত অভিযোগ কেন? কেন দাগিরা এখনও শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সরকারি জায়গায় ব্যানার, হোর্ডিংই বা এখনও রয়েছে কেন?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৬ ০৪:০৭
Share:

মঙ্গলবার নিউটাউনে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী।ছবি: শৌভিক দে

প্রশ্নটা ছুটে এল গোলার মতো। ‘‘হোয়্যার ইজ সিপি?’’ পুলিশ কমিশনার কোথায়?

Advertisement

কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানালেন, সিপি বিকেল সাড়ে তিনটেয় আসবেন। তাতে অবশ্য লাভ হল না। দ্বিগুণ কড়া গলায় নির্দেশ এল, সিপি-কে এখনই আসতে বলুন। তড়িঘড়ি হাজির হলেন রাজীব কুমার। এসে জবাবদিহি করতে হল, কলকাতা নিয়ে এত অভিযোগ কেন? কেন দাগিরা এখনও শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সরকারি জায়গায় ব্যানার, হোর্ডিংই বা এখনও রয়েছে কেন?

মঙ্গলবার বিকেলে নিউটাউনে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তা এবং জেলার ডিএম-এসপিদের সঙ্গে ভোট প্রস্তুতি নিয়ে এ রকমই কড়া ধাঁচের বৈঠক করল কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ। আর ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, রাজ্যের ইতিহাস-ভূগোল গুলে খাওয়া আছে তাদের। কোথাও কোনও রকম বেচাল সহ্য করা হবে না। রাজ্যের বাঘা বাঘা আইএএস, আইপিএস অফিসারেরা মঙ্গলবার সকাল থেকেই যথেষ্ট উদ্বেগে ছিলেন। বৈঠক শেষে তো তাঁদের কার্যত থরহরিকম্প দশা।

Advertisement

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী এমনিতেই কড়়া ধাতের প্রশাসক বলে পরিচিত। তার উপরে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই যে পরিমাণ অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করেছে কমিশনের কাছে, তাতে তিনি আরও বেশি সতর্ক। নবান্নের কর্তারা বলছেন, লোকসভা বা বিধানসভা ভোট নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে হলেও বাস্তবে রাজ্য সরকারের প্রভাব মুছে ফেলা যায় না। কমিশন সামান্য রাশ আলগা দিলেই প্রতাপ বাড়ে শাসক দলের। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে সেই ছবিই দেখা গিয়েছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। সে বার গোড়ায় প্রচুর হম্বিতম্বি করেও শেষে গুটিয়ে গিয়েছিল কমিশন। গত পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেও সুরাহা হয়নি। কিন্তু এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই যেন কমিশন এ বারে মাঠে নেমেছে। দু’এক দিনের মধ্যেই শাসক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বেশ কয়েক জন আমলা ও পুলিশ অফিসারকে সরানো হবে বলে বার্তা দিয়ে গিয়েছেন জৈদী।

এ বারেই প্রথম ভোটের দিন ঘোষণার আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে শহর থেকে গ্রামে রুটমার্চ করছে। এ দিন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, শুধু রুটমার্চ নয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী এ বার গ্রামের ভিতরে ঢুকবে। কয়েক দিনের মধ্যে রাজ্যে বিশেষ পর্যবেক্ষক ও পুলিশ পর্যবেক্ষক আসারও ইঙ্গিত মিলেছে। এবং গত দু’দিনের বৈঠকে পরিষ্কার, শুধু ডিএম-এসপি-দের রিপোর্ট নয়, নিজস্ব সূত্রেও খবর জোগাড় করে কমিশন একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে। এ দিন যে ভাবে জৈদী ডিএম-এসপিদের ধমকেছেন, যে ভাবে প্রত্যন্ত এলাকার খুঁটিনাটি নিয়ে খোঁজ নিয়েছেন, সেটা বেনজির বলেই মনে করা হচ্ছে।

শুধু সিপি নন, কমিশনের তোপ থেকে রেহাই পাননি উত্তর কলকাতার নির্বাচনী অফিসার অমরনাথ মল্লিকও। তাঁর কাছে কমিশনের প্রশ্ন ছিল, আপনার এলাকায় কত কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে? অমরনাথবাবু তা বলতে না পারায় বেজায় চটে জৈদী মন্তব্য করেন, ‘‘আপনি নির্বাচনী অফিসার। জানেন না, কত কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে?’’ একই প্রশ্নে ধমক খান দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং মালদহের ডিএম-রাও। অমরবাবুর বিড়ম্বনা অবশ্য এতেই শেষ হয়নি। তাঁর জন্য প্রশ্ন ছিল, শহর জুড়ে হোর্ডিং-ব্যানার। খোলা হয়নি কেন? জবাবে অমরনাথবাবু বলেন, ‘‘আমার লোকজন নেই। তাই খোলা যায়নি।’’ খেপে গিয়ে তখনই কলকাতার পুর কমিশনার খলিল আহমেদকে ডেকে পাঠান জৈদী। নির্দেশ দেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত হোর্ডিং নামিয়ে ফেলতে হবে।

ফুলবেঞ্চের এ দিনের বৈঠকের এটা ছিল একটা ঝলক মাত্র। সরকারি অফিসাররা জানাচ্ছেন, সারা দিন ধরে দফায় দফায় একাধিক ডিএম, এসপি-কে কার্যত তুলোধনা করেছেন কমিশনের সদস্যরা। বুঝিয়ে দিয়েছেন, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পথে সামান্যতম গড়বড় হলে তাঁরা কাউকে রেয়াত করবেন না। এ দিন বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ প্রশাসনকে সবচেয়ে বেশি বকাঝকা করেছে কমিশন। বলেছে, ‘‘এই চার জেলা থেকেই সবচেয়ে অভিযোগ এসেছে। গত কয়েক মাসে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে রাজ্য নিয়ে যা খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সবই এই চার জেলাকে ঘিরে।’’ মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে এবং ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে ডেকেও জৈদী বলেন, ‘‘এত অভিযোগ কেন? জেলার পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়।’’

এ দিন মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিস্থিতি বলতে ওঠামাত্র জৈদী তাঁর কাছে জানতে চান, ‘‘কী পরিমাণ নকল নোট উদ্ধার করেছেন?’’ প্রসূন জানান, ১৪ লক্ষ টাকার নকল নোট উদ্ধার হয়েছে। কমিশনার পাল্টা তাঁকে বলেন, ‘‘আপনার জেলা দেশে নকল নোটের হাব। আর সেখান থেকে মাত্র ১৪ লক্ষ টাকার নোট পেলেন!’’ এর পরেই মালদহের জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদীর দিকে নজর ঘুরিয়ে কমিশনার বলেন, ‘‘এত ঘটনা ঘটছে আর আপনি দেড় মিনিটে রিপোর্টিং সেরে ফেললেন! আর কখন সিরিয়াস হবেন?’’ বৈঠকে উপস্থিত এক জেলাশাসক পরে জানালেন, ‘‘বেশ চলছিল। মালদহের পুলিশ সুপারকে দেখেই মেজাজ হারান কমিশনার।’’ মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রত্নাকর রাও যখন বলতে শুরু করলেন, তাঁকে থামিয়ে দিলেন জৈদী। বললেন, ‘‘আপনি তো দু’বছরের বেশি জেলায় রয়েছেন। তা হলে ২০১৪ সালের কথা বলছেন কেন? এখনকার কথা বলুন। কী কাজ করেছেন যে জেলায় বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে?’’

বীরভূমের এসপি মুকেশ বোমা উদ্ধার, গ্রেফতারি ইত্যাদি নিয়ে নানা তথ্য দিচ্ছিলেন। জৈদী পাল্টা তাঁকে বলেন, ‘‘আপনার নামে এত অভিযোগ কেন?’’ তার পরেই বর্ধমানের ডিএম-এসপি’কে ফুটিসাঁকোর পরিস্থিতি নিয়ে নজর দেওয়ার নির্দেশ আসে। বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ সীমানায় ফুটিসাঁকো বোমা-বন্দুক-অপরাধীর আড়ত বলে পরিচিত। কমিশন বুঝিয়ে দেয়, রাজ্যের হাঁড়ির খবর তার জানা আছে। ১২ হাজার এলাকাকে গোলমালপ্রবণ বলে ঘোষণা করে এবং ৩১ হাজার দাগি অপরাধী যে এখনও জেলের বাইরে, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে জৈদীর নির্দেশ, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে সতর্ক করে কমিশনার বলেন, ‘‘আপনার শেষ পর্বে ভোট। হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, কলকাতা থেকে দুষ্কৃতীরা ঢুকতে পারে।’’ উত্তর ২৪ পরগনার জন্যও একই নির্দেশ যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন