প্রয়োজনের সময়ে নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন থাকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অতিসক্রিয়তার জন্য পুলিশকে বারবার তিরস্কার করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। পরিবেশ দূষণে নজর রাখার দায়িত্ব পেয়েও কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ উৎসবের মরসুমে কী ভাবে বেমালুম নিষ্ক্রিয় থাকল, সেই প্রশ্ন তুলে এ বার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করল জাতীয় পরিবেশ আদালতও।
নিছক ক্ষোভ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি ওই আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ। পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুর্গা ও কালীপ্রতিমা ভাসানে কী ভাবে অবাধে ডিজে (বড় সাউন্ডবক্স, চলতি কথায় ডিজে) বাজানো হল, কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে সেই প্রশ্নের জবাব তলব করেছে তারা। সেই সঙ্গে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ দফতরের কর্তাদেরও। ১২ ডিসেম্বর লিখিত জবাব পেশ করতে বলা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রকাশ্যে ডিজে বা ডিস্ক-জকি বাজানো নিষিদ্ধ। কোনও অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ডিজে বাজানো হচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে নজরদারির দায়িত্ব পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পরিবেশ দফতরের। কেউ প্রকাশ্যে ডিজে বাজালে পুলিশকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযুক্তদের পাঁচ বছরের জেল এবং পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানার কথাও বলা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে। কিন্তু বঙ্গবাসীর অভিজ্ঞতা, এ বারেও দুর্গা ও কালীপ্রতিমা বিসর্জনে যথেচ্ছ ডিজে বাজানো হয়েছে পুলিশকর্মীদের সামনেই। আইনরক্ষকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। সক্রিয় ভাবে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, টুঁ শব্দটিও করেননি। কারও বিরুদ্ধে কোনও মামলাও দায়ের করেননি তাঁরা।
পরিবেশকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে আগেই সরব হয়েছিলেন। পুলিশ ও রাজ্যের পরিবেশ দফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার কলকাতায় একই প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ডিজি নিয়ে মাতামাতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নিয়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকল কী করে, সেই বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিচারপতি এস পি ওয়াংদি এবং বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ।
শুধু ডিজে বাজানো নয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাত ১০টার পরে মাইক বাজানোও নিষিদ্ধ। এই সব ক্ষেত্রে সাউন্ড লিমিটার লাগানোরও নির্দেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু বিভিন্ন বিজয়া সম্মিলনীতে কলকাতা-সহ রাজ্যের সব জেলাতেই রাত ১০টার পরে দেদার মাইক বাজিয়ে জলসা হয়েছে। এমনকী থানা-চত্বরেও মাঝরাতের পরে মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করার অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রেও পুলিশ আর পরিবেশ দফতরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন পরিবেশবিদেরা। জগদ্ধাত্রী পুজোতেও বিভিন্ন জায়গায় রাতভর জলসা হয়েছে এবং হচ্ছে।
এ ভাবে জলসা চললে পুলিশকেই ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আইনে বলা হয়েছে, বিধি ভেঙে জলসা চললে পুলিশ প্রথমে জলসা বন্ধ করে মাইক বাজেয়াপ্ত করবে। তার পরে পরিবেশ আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করবে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রেও পাঁচ বছরের জেল এবং এক লক্ষ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, একটি ক্ষেত্রেও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করেনি পুলিশ। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফেও নজরদারি ছিল না কোথাও।
রাত ১০টার পরে প্রকাশ্যে মাইক বাজানো হল কেন, পরিবেশ আদালত এ দিন সেই প্রশ্নও তুলেছে। এই বিষয়েও কলকাতার সিপি, রাজ্য পুলিশের ডিজি, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং রাজ্য পরিবেশ দফতরের পৃথক জবাবদিহি তলব করেছে তারা।
কলকাতায় শব্দের উৎপাত নিয়ে পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সেই মামলাতেই এ দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালত। সুভাষবাবু জানান, শব্দদূষণ নিয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা করেছিল কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তাতে দিল্লি ও মুম্বইয়ের পরেই ছিল কলকাতা। সুভাষবাবুর প্রশ্ন, দিল্লি ও মুম্বইয়ে যে-বিপুল সংখ্যক গাড়ি ও ট্রেন চলে, তার চেয়ে অনেক কম চলে কলকাতায়। তা হলে এই মহানগরীতে শব্দমাত্রা বা শব্দদূষণের মাত্রা শনৈ শনৈ বাড়ছে কী ভাবে? এসএসকেএম রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। অথচ সেই হাসপাতালের কাছে সব সময়েই শব্দমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উপরে থাকে বলে জানান তিনি।
১২ ডিসেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা। কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং পরিবেশ দফতর সে-দিন কী জবাব দেয়, সেই দিকেই তাকিয়ে আছেন পরিবেশকর্মীরা।