নজর নেই, গাড়ি টিসি নম্বরেই

নিয়মটা সবাই জানেন। কিন্তু তা ভাঙাই যেন দস্তুর। গাড়ি কেনার পরে তা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার জন্য তর সয় না অনেক ক্রেতার। পরিবহণ দফতরে রেজিস্ট্রেশনের আগে এমন কাজ যে করা উচিত নয়, তা জেনেশুনেও বাধা দেন না ডিলারেরা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৪৭
Share:

বাঁকুড়ার পথে। বৃহস্পতিবার নিজস্ব চিত্র।

নিয়মটা সবাই জানেন। কিন্তু তা ভাঙাই যেন দস্তুর। গাড়ি কেনার পরে তা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার জন্য তর সয় না অনেক ক্রেতার। পরিবহণ দফতরে রেজিস্ট্রেশনের আগে এমন কাজ যে করা উচিত নয়, তা জেনেশুনেও বাধা দেন না ডিলারেরা। তাঁদের যুক্তি, সেক্ষেত্রে ক্রেতারা চলে যাবেন অন্য ডিলারের কাছে। ফলে, শুধু ডিলারদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য দেওয়া ট্রেড সার্টিফিকেট (টিসি) নম্বরের গাড়ি দিব্যি ছুটছে রাস্তায়। নজরদারির কথা যাদের, সেই পরিবহণ দফতরের কর্তাদের দাবি, কর্মীর অভাব এ সব অনিয়ম নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।

Advertisement

বুধবার কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে যে গাড়িটির ধাক্কায় এক সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয়, সেটির রেজিস্ট্রেশনই হয়নি। গাড়িটি চলছিল টিসি নম্বর নিয়ে। ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট গাড়ি-ডিলারকে শো-কজ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা বর্ধমানের নানা জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, এ ভাবে টিসি নম্বরেই ভুরিভুরি নতুন গাড়ি নেমে পড়ছে রাস্তায়।

পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, যে কোনও গাড়ির ক্ষেত্রে টিসি নম্বরটি দেওয়া হয় ডিলারের ব্যবহারের জন্য। গাড়ি কেনার পরে পরিবহণ দফতর থেকে ক্রেতার নামে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়ার পরে ক্রেতা তা ব্যবহার করতে পারেন। তার মধ্যে সেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা নিয়মবিরুদ্ধ। তবে ডিলার নিজে ওই গাড়ি রাস্তায় নামাতে পারেন।

Advertisement

অথচ, নিয়ম যে দেদার ভাঙা হচ্ছে তা জানা যায় বিভিন্ন গাড়ির শো-রুমে গেলেই। গাড়ির ডিলারেরা জানান, দশ-পনেরো বছর আগেও এই ধারা ছিল না। গাড়ি কেনার পরে রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে পর্যন্ত তা শো-রুমের গ্যারাজেই রেখে যেতেন বেশির ভাগ ক্রেতা। অনেকে নিয়ে চলে গেলেও তা নিয়ে রাস্তায় নামতেন না। সচেতন নাগরিকেরা এখনও তা করেন। কিন্তু তেমন ক্রেতার সংখ্যা কমছে। আসানসোলের গাড়ি ডিলার দীপক রুদ্র বলেন, ‘‘এখন পরিবহণ দফতর থেকে হাই সিকিওরিটি নম্বরপ্লেট পেতে দিন পনেরো থেকে এক মাস লাগে। যাঁরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গাড়ি কেনেন, তাঁরা এই ক’দিন গ্যারাজে রাখতে রাজি হন না।’’ দুর্গাপুরের এক গাড়ি-ডিলারের কথায়, ‘‘গাড়ি কিনেই তা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন বেশির ভাগ ক্রেতা। শহরের মধ্যে সেই গাড়ি নিয়ে বিপাকে পড়লে অনেক ক্রেতা দাবি করেন, পরিবহণ দফতরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এলাকার বাইরে দুর্ঘটনা ঘটলে মুশকিলে পড়ে যান।’’

কিন্তু রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর ব্যাপারে ডিলারদের তরফে কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হয় না কেন? দুর্গাপুরের ওই ডিলারের যুক্তি, ‘‘ক্রেতারা অপেক্ষা করতে রাজি হন না। জোর করলে অনেকে বিরক্তও হন। কমবয়সী ক্রেতারা বেশি খেপে ওঠেন। বিক্রি কমার আশঙ্কায় আমরাও বেশি চাপাচাপি করতে পারি না। ডিলারেরা একজোট না হলে এটা আটকানো মুশকিল।’’

একই বক্তব্য বাঁকুড়ার দুই গাড়ি-ডিলারেরও। তাঁদের কথায়, ‘‘অনেকের কাছেই গাড়ি কেনা সাধের ব্যাপার। টাকা দেওয়ার পরেও যদি গাড়ি হাতে তুলে না দেওয়া হয় তাহলে অন্য শো-রুম থেকে কিনে নেওয়ার কথা বলেন তাঁরা। আমরা বাধ্য হই গাড়ি দিয়ে দিতে।” তবে রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে না যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া বলে জানান তাঁরা।

কেমন সে সতর্কতা? সরকারি বিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন এমন একাধিক ক্রেতার অভিজ্ঞতা, ‘‘আমাদের বলা হয়েছিল, সন্ধ্যার মধ্যে গাড়ি গ্যারাজে তুলে ফেলতে। আর দিনের বেলায় জেলা সদরে বিশেষ, ঘোরাঘুরি না করতে।’’

সদ্য গাড়ি কেনা অনেক ক্রেতা আবার অন্য যুক্তিও দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, শো-রুম থেকে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করাতে হলে বেশ কিছুটা বাড়তি খরচ হয়। নিজেদের উদ্যোগে তা করে নিলে সেই খরচ বাঁচে। তাই গাড়ি কেনার পরে টিসি নম্বর দেওয়া অবস্থাতেই তা নিয়ে বাড়ি চলে আসেন তাঁরা। তবে রেজিস্ট্রেশনের আগে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামা বেআইনি জানা সত্ত্বেও তা করছেন কেন, অনেক ক্রেতাই তার কোনও সদুত্তর দেননি। বাঁকুড়ার রাস্তায় এমন একটি গাড়ির মালিককে সে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘শহরের মধ্যেই আস্তে-আস্তে চালাচ্ছি। বাইরে তো কোথাও যাচ্ছি না।’’ শো-রুম থেকে গাড়ি কিনে নিয়ে যাওয়ার পথে পুরুলিয়ার এক ক্রেতার আবার সাফ জবাব, ‘‘আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। তাতেই হবে।’’

গোটা বিষয়টি জেনেশুনেও কার্যত হাত গুটিয়ে রয়েছে পরিবহণ দফতর। আসানসোল মহকুমা পরিবহণ আধিকারিক মৃন্ময় মজুমদারদের বক্তব্য, ‘‘নির্দিষ্ট তথ্য-সহ অভিযোগ পেলে আমরা এই সব গাড়ি ধরি। রাস্তায় নজরে পড়লেও ধরা হয়।’’ তবে তাঁদের দাবি, অল্প সংখ্যক কর্মী ও সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে দফতর চালাতে গিয়ে কড়া নজরদারি সম্ভব হয় না। বাঁকুড়ার পরিবহণ আধিকারিক সৌমেন দাস অবশ্য দাবি করেন, মাঝে-মধ্যেই তল্লাশি থেকে ডিলারদের সতর্ক করা— এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ করে থাকেন তাঁরা। তিনি বলেন, “টিসি নম্বরের গাড়ি রাস্তায় চললে আমরা মালিক ও ডিলার, দু’জনকেই জরিমানা করি।’’

রাস্তায় টিসি নম্বরের গাড়ির দৌড় দেখে যদিও তা বোঝার উপায় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন