খাঁ খাঁ আউশগ্রামে চলছে পুলিশি টহল, তৃণমূল যোগ মেনে নিচ্ছেন কেষ্টই

পুলিশের উপরে হামলায় তৃণমূল নেতাকে আগেই ধরেছিল বর্ধমান জেলা পুলিশ। এ বার গ্রেফতার হলেন সিপিএম নেতাও। শনিবার আউশগ্রামে থানা ভাঙচুরের ঘটনার পরে পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবারই নির্দেশ দেন, যে-ই জড়িত হোক, ধরতে হবে।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

আউশগ্রাম শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৭
Share:

ধৃত তৃণমূল কাউন্সিলর চঞ্চল গড়াই।নিজস্ব চিত্র

পুলিশের উপরে হামলায় তৃণমূল নেতাকে আগেই ধরেছিল বর্ধমান জেলা পুলিশ। এ বার গ্রেফতার হলেন সিপিএম নেতাও।

Advertisement

শনিবার আউশগ্রামে থানা ভাঙচুরের ঘটনার পরে পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবারই নির্দেশ দেন, যে-ই জড়িত হোক, ধরতে হবে। ওই ঘটনায় সিপিএমের সঙ্গে আরও কেউ ইন্ধন জুগিয়ে থাকতে পারেন, দাবি করেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। ‘আরও কেউ’ বলতে নিজের দলের একাংশের কথাই বুঝিয়েছিলেন তিনি। তার পরেই শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হয় গুসকরা পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বর্তমানে তৃণমূল কাউন্সিলর চঞ্চল গড়াই-সহ ১১ জনকে। রবিবার পুলিশ ধরে সিপিএমের আউশগ্রাম জোনাল সম্পাদক সুরেন হেমব্রমকে।

শাসকদলের তরফে বর্ধমানের আউশগ্রাম, কেতুগ্রাম ও মঙ্গলকোট বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুব্রত এ দিন অভিযোগ করেন, ‘‘সিপিএমের নেতা-কর্মীদের উস্কানি দিয়েছেন বুড়ো চঞ্চল গড়াই। অন্যায় করেছে, তাই গ্রেফতার হয়েছে!’’ তবে, বর্ধমানের সিপিএম নেতা অমল হালদারের দাবি, ‘‘শনিবার সারা দিন সুরেন দুর্গাপুরে দলের সভায় ছিলেন। তৃণমূল নেতাদের কথা প্রতিষ্ঠিত করতে পুলিশ ওঁকে ধরল।’’

Advertisement

স্কুলের জায়গায় আউশগ্রাম থানার এক সিভিক ভলান্টিয়ার অবৈধ নির্মাণ করছেন, এই অভিযোগ জানাতে কিছু শিক্ষক ও পড়ুয়াকে নিয়ে শুক্রবার থানায় গিয়েছিলেন আউশগ্রাম হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি, এলাকার তৃণমূল নেতা চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ হলে পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ বাধে। চন্দ্রনাথবাবু-সহ তিন শিক্ষককে পুলিশ সে দিন আটক করে।

জেলা পুলিশ সূত্রের দাবি, অবরোধের পিছনে সুরেনবাবুর মদত ছিল। শনিবার সকালে একটি লাল গাড়িতে মাইক বেঁধে আশপাশের গ্রামে অভিভাবকদের স্কুলের সামনে জড়ো হতে বলা হয়। তার আগে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ স্কুলের শিক্ষক তাপস রায়ের (গ্রেফতার হয়েছেন) বাড়িতে বৈঠক করেন তৃণমূলের একটি গোষ্ঠীর লোকজন। গুসকরা থেকে সকালে এলাকায় পৌঁছে যান চঞ্চলবাবুও। চঞ্চলবাবু ও চন্দ্রনাথবাবুর এলাকায় প্রভাব রয়েছে। পুলিশ চন্দ্রনাথবাবুকে আটক করায় থানার আইসি ইমতিয়াজ খানের বিরুদ্ধে এমনিতেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। স্কুলের বৈঠকে তা আরও বাড়ে। এর পরে স্কুলে জড়ো হন সকলে। পুলিশ কী ভাবে ‘অত্যাচার’ করেছে, থানা থেকে ছাড়া পাওয়া চন্দ্রনাথবাবু ও শিক্ষকেরা তাঁদের সেই বর্ণনা দেন।

পুলিশের দাবি, সেখানে সিপিএমের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য মদন হাঁসদাও উত্তেজক ভাষণ দেন। তার পরেই জনতা স্কুল থেকে কয়েক পা দূরে থানায় ছোটে। থানায় দফায়-দফায় ভাঙচুর, আগুন লাগানো, পুলিশকর্মীদের মারধর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ দাবি করেন, প্রাণ বাঁচাতে অনেক পুলিশকর্মী মালখানা, লক-আপে ঢুকে পড়েন। কেউ-কেউ পাঁচিল টপকে পিছনের জঙ্গলে পালিয়ে যান। যদিও পুলিশের দাবি, পুলিশকর্মীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। কেউ পালিয়ে যাননি।

কিন্তু কয়েকশো লোক তাঁদের ঘিরে ফেলেছিল। থানায় ঢোকা-বেরনোর একটাই দরজা। ফলে, পুলিশকর্মীদের জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার কথা রটনা বলেও জেলা পুলিশের দাবি।

প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ধরপাকড়ে নামে বিশাল পুলিশবাহিনী। সেই ভয়ে এলাকা জনশূন্য। সুনসান রাস্তায় শুধুই পুলিশ ও র‌্যাফ। দোকানপাট প্রায় খোলেনি। রবিবারের হাটও ছিল বন্ধ। পোলিও খাওয়ানোর শিবিরেও ভিড় ছিল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত আশাকর্মীরা বললেন, ‘‘গ্রামে তো প্রায় কেউ নেই। কে আর আসবে!’’ বাড়িতে গিয়ে পঞ্চায়েত সদস্য মদনবাবুকেও পায়নি পুলিশ। সুরেনবাবুর স্ত্রী উর্মিলাদেবী বলেন, ‘‘পুলিশ শনিবার মাঝ রাতে স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। কেন নিয়ে গেল বুঝতে পারছি না!’’ থানার গেট এ দিন বন্ধ ছিল। জেলার পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, ‘‘এলাকায় শান্তি রাখতে টহল চলছে। যাঁরা গ্রামের বাইরে আছেন, তাঁদের ফিরে আসতে বলা হচ্ছে।’’

সিপিএম নেতাদের দাবি, দলে কোণঠাসা চঞ্চলবাবু ও অনুগামীরা জমি পেতে হামলায় ইন্ধন দিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোমের বক্তব্য, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলরা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামাতে ব্যর্থ। দলনেত্রীর কাছে তা গোপন করতে পুলিশকে কাজে লাগিয়ে সিপিএমের নাম জড়াচ্ছেন।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘আমাদের নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরে এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী দাবি করেন, সরকারের উপরে মানুষের আস্থা উঠে গিয়েছে। আউশগ্রামের মতো ঘটনা তারই প্রতিফলন।

সিপিএমের বক্তব্যকেই কার্যত সমর্থন করে কোর্ট চত্বরে চঞ্চলবাবু বলেন, ‘‘চন্দ্রনাথকে ছে়ড়ে দিয়েছে শুনে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার হলাম।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সারা জীবন সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে তৃণমূল জমানায় সেই অভিযোগেই গ্রেফতার হতে হল!’’ আদালত তাঁকে দু’দিন পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছে। অনুব্রত অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা উড়িয়ে বলেন, ‘‘চঞ্চলের সঙ্গে এখন দলের কোনও লোকই নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন