ভাল-থাকা: গানের মহড়ায়। নিজস্ব চিত্র
কাজ সেরে ছেলের বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়। তার আগেই বাড়ি ছাড়েন মা। কিছুটা দূরে গিয়ে করলা নদীর বাঁধে পায়চারি করতেন সন্ধে পর্যন্ত। বাড়িতে ফিরলেই যে মদ খাওয়ার টাকা চাইবে ছেলে। টাকা না থাকলে গয়না।
ঘুম থেকে উঠে আর এক বৃদ্ধা সারাদিন গিয়ে বসে থাকতেন পড়শির বাড়িতে। মদ্যপ জামাই সারাদিন বাড়িতে চিলচিৎকার করে। নেশা করতে করতে সন্ধের মধ্যেই জামাই বেহুঁশ হয়ে গেলে বাড়ি ফিরতেন শাশুড়ি।
জলপাইগুড়ি শহরের টিকিয়াপাড়ার বাসিন্দা দুই বৃদ্ধের এই রুটিন হালফিলে একটু বদলেছে। তবে ছেলে বা জামাই কেউই নেশা ছাড়েনি, কিন্তু তিতিবিরক্ত বৃদ্ধারা খোঁজ পেয়েছেন এক নতুন নেশার। বিকেল হলেই চলে আসছেন গানের ক্লাসে। মহড়া-আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরছেন রাতে। বেসরকারি-সরকারি নানা অনুষ্ঠানে ডাকও আসছে তাঁদের দলের। ঘরোয়া অশান্তির শিকার আঠারো জন বৃদ্ধা বিষহরা গানের দল গড়েছেন জলপাইগুড়িতে। দলের সদস্য বাসনাদেবী বললেন, “কত অনুষ্ঠানে গাইছি, হাততালি পাচ্ছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম, জীবনটা লাথি-ঝাঁটা খেয়েই কেটে যাবে। গানের সুর সব বদলে দিয়েছে।”
জলপাইগুড়ির রেসকোর্স পাড়ার বাড়িতেই রূপান্তরকামী সংগঠনের একটি নাচের স্কুল চালান সৌগত মুখোপাধ্যায়। সেই স্কুলেই গানের দলের মহড়া চলে। দলের নাম জলপাইগুড়ি মহিলা বিষহরা সমিতি। বাড়িতে কাজের মাসির কাছে প্রথম নেশাগ্রস্ত ছেলের হাতে মার খাওয়ার কথা শুনেছিলেন সৌগত। তিনি বলেন, “বিকেলে ছেলে ফেরার সময় হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাসি বাঁধে গিয়ে বসে থাকত। কাঁদত। মাসির মুখেই শুনেছি ওই এলাকায় প্রায় সব বৃদ্ধাদেরই এমনই দশা। সকলকে ডেকে গানের দল তৈরি করে দিয়েছি।” সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে কখনও তিস্তাবুড়ির গান শোনান, কখনও বা মেছেনি-ভাওয়াইয়া। সৌগত বলেন, “ওঁরা আগে থেকেই এইসব গান জানতেন। আমি শুধু তালিম দিয়েছি।’’
জলপাইগুড়ি শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তাঁরা সকলে। এলাকার দু’টি কলোনিতে বাড়ি বাড়ি নেশার প্রবণতার কথা জানেন স্থানীয় কাউন্সিলরও। কাউন্সিলর প্রমোদ মণ্ডল বলেন, “বেশ কয়েকবার সচেতনতা শিবির করেছি। কোনও লাভ হয়নি।” সন্ধ্যা বর্মন, পুষ্প রায়, যশোদা রায়, হীরা রায়, বাসনা বর্মণ, সন্ধ্যা রায়দের কেউ কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করেন। যাঁরা করেন না, তাঁরা এখন সকাল থেকে এলাকায় কারও বাড়িতে জড় হয়ে গানবাজনা করেন। বিকেল হতেই চলে আসেন রেসকোর্স পাড়ায়। গিরিবালা দেবী (নাম পরিবর্তিত) বললেন, “পেটের ছেলেটাই নেশার ঘোরে আমাকে মারে। পাশের বাড়িতে আমারই মতো এক বৃদ্ধা মার খায় তার জামাইয়ের হাতে। কিন্তু আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। এখন গানের ক্লাসেই বেশি সময় কাটে আমাদের। ওই সময় অশান্তির কথা ভুলে থাকি।’’