হতাশ। কর্মীদের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। —নিজস্ব চিত্র।
সকাল বেলায় দলের অস্থায়ী বুথ অফিসে এসে খবর দেখার জন্য একটা টিভি নিয়ে আসতে বলেছিলেন কর্মী-সমর্থকদের। তখন সকাল সাড়ে ৮টা। টিভি এলে চেয়ার টেনে সে দিকে ঘুরে বসলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দার্জিলিং জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌতম দেব। হাতে লালচে রঙের কাপে চিনি ছাড়া চা। মন্ত্রীর নির্দেশে আনা সেই টিভি-ই দুপুরে ‘অস্বস্তিকর’ পরিস্থিতি তৈরি করবে তা অবশ্য কর্মী-সমর্থকরা আঁচ করতে পারেননি।
শিলিগুড়ি পুরসভার ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে তখন ৪৩টির ফলাফল সরকারি ভাবে ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য তখন টিভি কর পর্দা জুড়ে। অশোকবাবু সাক্ষাৎকারে দাবি করে চলেছেন, ‘‘উত্তরববঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের অহঙ্কার, দুর্নীতি-সন্ত্রাসকে প্রশয় দেওয়ার বিরুদ্ধে শিলিগুড়ির মানুষ রায় দিয়েছে।’’ টিভিতে জোর ভলিউমে সেই সাক্ষাৎকার চলছে। চারদিকে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। টিভির সামনে বসে মন্ত্রী গৌতমবাবুর মাথা একদিকে কাত হয়ে রয়েছে, চোখ মাটির দিকে। এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করছেন। ভিড়ের মধ্যে এক কর্মী বললেন, ‘‘চ্যানেলটা বদলে দে।’’ যদিও, কেউই চ্যানেল বদলাতে গেলেন না। টিভিতে চলতে থাকল অশোকবাবুর সাক্ষাৎকার। সামনে চেয়ারে নিঃশব্দে বসে থাকলেন মন্ত্রী গৌতমবাবু।
মঙ্গলবার গণনা শুরুর দশ মিনিট আগেই শিলিগুড়ি সিস্টার নিবেদিতা স্কুলের সামনে সস্ত্রীক চলে এসেছিলেন গৌতমবাবু। প্রথম ধাক্কাটা আসে তার কিছু পরেই। ঘরোয়া আলোচনায় দলের প্রবীণ নেতা প্রতুল চক্রবর্তীকে সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে তৃণমূল নেতারা আলোচনা করছিলেন। গণনাকেন্দ্র থেকে প্রথম খবরটা পৌঁছয়, প্রতুলবাবু হেরে গিয়েছেন। শুনে যিনি খবর এনেছিলেন, মন্ত্রী নিচু স্বরে তাঁকে বললেন, ‘‘আরেকবার খোঁজ নিয়ে দেখ।’’ কিন্তু দেখা গেল, একের পর এক ধাক্কা আসতেই থাকল। দলের প্রার্থীদের হারের কথা শুনে কখনও এক পায়ের উপর অন্য পা চাপিয়ে দিয়েছেন, কখনও বা দু’হাতে মাথার পিছনে এনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন মন্ত্রী।
হারের কান্না। চোখে জল এক তৃণমূল কর্মীর। ছবি: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দলের জয়ী প্রার্থীরা গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে, কেউ প্রণাম করেছেন, কেউ বা হাত মিলিয়েছেন। যেমন স্ত্রী শুক্লাদেবীও জয়ের শংসাপত্র নিয়ে গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে হাসি মুখে গৌতমবাবুর পাশে এসে বসেন। এক কর্মী বলেই ফেললেন, ‘‘দাদা, বৌদি কিন্তু তোমার আগের বারের মার্জিন থেকেও বেশি ভোটে জিতেছে।’’ রসিকতার উত্তরে একবার মুচকি হাসলেন মাত্র। মুহুর্মুহু মোবাইল বেজেই চলেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ফোনই তিনি তোলেননি। সঙ্গে থাকা কর্মীদের কয়েকটি ফোন ধরে ‘‘দাদা ব্যস্ত আছে’’ জানিয়েছেন। দুপুরের পরে অবশ্য একটি ফোন পেয়ে হঠাৎই ব্যস্ততা দেখা গিয়েছে মন্ত্রীর। ভাল ভাবে কথা শোনার জন্য এক কানে মোবাইল দিয়ে অন্য কান হাত দিয়ে চেপেছেন। পাশে থাকা এক কর্মীর ধারণা, ‘‘দিদি ফোন করেছেন বোধহয়।’’
ফোনের অন্য প্রান্তে কে ছিলেন জানা না গেলেও, মন্ত্রীর মুখে শুধু ‘হ্যা’, ‘না’ শোনা গেল। তত ক্ষণে সব ওয়ার্ডের ফলাফল প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে, পুরবোর্ড দখলে ‘ম্যাজিক’ সংখ্যা হাসিল করতে বামেদের প্রয়োজন মাত্র একটি আসন। তৃণমূল অনেক পিছনে। দলের বিপর্যয়ে বুথ অফিস ফাঁকা হতে শুরু করে দিয়েছে।
বুথে বসেই মন্ত্রীকে এক কর্মী জানালেন, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের জেতা নির্দল প্রার্থী অরবিন্দ ঘোষ বামেদের সমর্থন করতে পারেন। এই ওয়ার্ডেই প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করেছিলেন গৌতমবাবু, দলের নির্দেশে পরে পিছিয়ে আসতে হয়। এই ওয়ার্ড থেকেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে জিতেছেন একদা গৌতমবাবুর ঘনিষ্ঠ অরবিন্দবাবু। আরও থমথমে হল গৌতমবাবুর মুখ। দলের বুথ অফিসের সামনেই তখন কর্মীরা প্রকাশ্যে অসন্তোষ উগরে দিচ্ছেন। কেউ অভিযোগ করছেন, ওয়ার্ড কমিটির কথা না শুনে উপর থেকে প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়ায় এই হার হয়েছে, কেউ বা অভিযোগ করলেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে দলের একাংশ নেতাদের যথেচ্ছ টাকা বিলি, ভয় দেখানোর অভিযোগ ওঠায় বাসিন্দারা তা ভাল ভাবে নেননি।
যে কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন, তাঁরা মন্ত্রীর সামনে গিয়ে সরাসরি অভিযোগ না জানালেও, কর্মীদের অভিযোগ হয়তো গৌতমবাবুর কানেও পৌঁছেছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে গৌতমবাবু বললেন, ‘‘দলের সভাপতি হিসেবে এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করছি। দলনেত্রীকে যা বলার বলব। কেন এই হার হল তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করব।’’
সকালের মতোই দুপুরে দেড়টা নাগাদ ফের বৃষ্টি নামল। উল্টো দিকের বামফ্রন্টের বুথ অফিসে তখন বৃষ্টির মধ্যেই অশোকবাবুকে সামনে রেখে মিছিল শুরুর প্রস্তুতি হয়েছে। গৌতমবাবু উঠে গাড়ির দিকে এগোলেন।