ক্ষমতা গিয়েছে বছর চারেক। তারপর তিস্তা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ফের ভোট আসতে দেখা গেল, জলকর নিয়ে অবস্থান বদলে ফেলেছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শিলিগুড়ি পুরভোটের প্রাক্কালে বামেদের তরফে যে ইস্তেহার প্রকাশ করলেন অশোকবাবু, তাতে জল নিয়ে পাওয়া গেল ভিন্ন সুর।
দু-দশক পুরমন্ত্রী থাকাকালীন অশোকবাবু জলকরের পক্ষে সওয়াল করেছেন বারবার। তৃণমূলের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে তা চালুও করেন পুরসভায়। সেই অশোকবাবু বলছেন, তিনি মেয়র হলে গরিবদের জলকরে ছাড় দেবেন। এমনকী, জল ও বিদ্যুতের সংযোগে পুরসভা ভর্তুকি দেবে বলেও আশ্বাস দিয়েছে বামেরা।
জমি নিয়েও অশোকবাবু ঘুরে গিয়েছেন ১৮০ ডিগ্রি। তাঁর আমলে রেলের জমি থেকে হরিজনদের সরিয়ে তৈরি হয় বাণিজ্যিক ভবন। শহরের বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীদের জমির পাট্টা দেওয়ার আর্জিও মানেননি তিনি। সেই অশোকবাবু এখন বলছেন, তিনি শিলিগুড়ির মেয়র হলে বিধান মার্কেট, হকার্স কর্নার, নিবেদিতা মার্কেটের মতো বাজারের ব্যবসায়ীদের জমির মালিকানা দেওয়া হবে। দু-দশক ধরে বসবাসরকারী হরিজনদের জমির পাট্টা দেওয়া হবে।
হকারদের ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়েছে। অশোকবাবুর মন্ত্রিত্বকালে একাধিক বার হকার উচ্ছেদ হয়। এখন তাঁর ইস্তেহার বলছে, তিনি মেয়র হলে হকারদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে, মধ্যবিত্তকে খুশি করতে ট্রেড লাইসেন্স ফি এবং বাড়ির প্ল্যান পাশ করানোর ফি কমাবে পুরসভা, বলছে ইস্তেহার।
অশোকবাবুর দাবি, ‘‘আমরা বরাবর মধ্যবিত্ত, গরিব মানুষের জন্য ভাবি। এগুলো নতুন কিছু নয়।’’ বিরোধীরা অবশ্য এই ভোল বদল নিয়ে টিপ্পনীর সুযোগ ছাড়েননি। বামেদের ইস্তাহার সম্পর্কে জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের প্রতিক্রিয়া, ‘‘অশোকবাবুদের হল কী! উনি যখন পুরমন্ত্রী ছিলেন তখন জলকর কমানো নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরব হওয়ায় তীব্র আপত্তি করেন। উনি ২৮ বছর শিলিগুড়ি পুরসভায় ক্ষমতায় থেকেও গরিবদের জমির পাট্টা, হরিজনদের পাট্টা দেননি।’’
জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি কৃষ্ণ পাল বলেন, ‘‘অর্ধেকের বেশি প্রতিশ্রুতি পালন করতে রাজ্য ও কেন্দ্রের অনুমোদন লাগবে। তা অশোকবাবু কী করে আনবেন তাই তো পরিষ্কার নয়।’’
অশোকবাবুরা তৃণমূলের সুরেই কথা বলা শুরু করেছেন বলে কটাক্ষ করছেন বিজেপি নেতারা। জেলা বিজেপির সভাপতি রথীন বসু যেমন বলেছেন, ‘‘আমরা তো ভাবছি, উনি তৃণমূলে না চলে যান।’’ তাঁর অভিযোগ, অপরিকল্পিত ভাবে শিলিগুড়িকে গড়ে তোলায় অশোকবাবুর ভূমিকা সব চেয়ে বেশি।
বামেদের ১৫ পাতার ইস্তাহারে ২৫ দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে শহরবাসীকে। সেখানে ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন ছাড়, ভর্তুকির পাশাপাশি পুরসভার দুর্নীতি এবং হয়রানি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। আবার বস্তিতে গৃহনির্মাণ, জমির পাট্টা প্রদান ছাড়াও, রেলের জমিতে বাসকারীদের পাট্টার জন্য রেলের দ্বারস্থ হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিরোধীদের একাংশের বক্তব্য, পুরবাসিন্দাদের যে যে অংশের মধ্যে প্রভাব হারিয়েছে বামেরা, তাঁদের কাছে ফের গ্রহণযোগ্য হওয়ার চেষ্টা করছেন অশোকবাবুরা। শহরের ১৫৪টি বস্তিতে বামেদের হটিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে তৃণমূল। বস্তিবাসীকে পাট্টা দেওয়ার লক্ষ্য সেই ভোট ফিরে পাওয়া। পুরসভার হাজার দুয়েক সাফাইকর্মী দীর্ঘদিন রয়েছেন পুরসভার জমিতে তৈরি ঝুপড়িতে। তাঁদের ভোট টানতে তাঁদের জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বাম ইস্তাহার।
শিলিগুড়ির তিনটি মার্কেটের প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীদের মধ্যে গত লোকসভায় বিজেপি অনেকটা এগিয়ে ছিল। সেখানে পুরনো ব্যবসায়ীদের জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জমি ফিরে পেতে চাইছে বামেরা। সেই সঙ্গে হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শহরের প্রায় হাজার দশেক ভোট তৃণমূল থেকে টানতে চাইছেন অশোকবাবু, মনে করছেন বিরোধী নেতারা।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘ভোট ব্যাঙ্ক দখলে আনার চেষ্টায় নেমেছেন অশোকবাবু। ইস্তাহারে তো আর কর লাগে না।’’