দাপট কমলেও থামেনি শব্দদানব

বিশেষ করে রাত ১০টা থেকে ১টা অবধি শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মালদহ বা রায়গঞ্জের মত শহরে পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে বাজি ফাটিয়ে ‘আনন্দে’ মেতেছেন বহু বাসিন্দা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০২:২২
Share:

বেআইনি: পথ আটকে চলেছে শব্দবাজির তাণ্ডব। বৃহস্পতিবার রাতে জলপাইগুড়ি শহরে। নিজস্ব চিত্র

গতবারের চেয়ে তুলনায় কম হলেও শব্দাসুরের দাপট পুরোপুরি রোখা গেল না উত্তরের জেলাগুলিতে। দীপাবলির দিন সন্ধ্যা থেকে শব্দবাজি খানিকটা কম ফাটলেও রাত বাড়তেই অনেক জায়গাতেই মাত্রা বেড়ে যায়৷ বিশেষ করে রাত ১০টা থেকে ১টা অবধি শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মালদহ বা রায়গঞ্জের মত শহরে পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে বাজি ফাটিয়ে ‘আনন্দে’ মেতেছেন বহু বাসিন্দা। পুলিশের তথ্য অনুসারে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই লুকিয়ে চুরি বাজি ফাটানোর চেষ্টা বেশি করে দেখা গিয়েছে। পুলিশ বড় রাস্তা থেকে পাড়ার অলিগলি, সর্বত্র ঘোরাঘুরি করে, গ্রেফতার করে চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার পরেই বাড়ি ছাদে, ফাকা মাঠেক কোণে বা রাস্তা আটকে বাজি ফাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

শিলিগুড়ি

শিলিগুড়ি শহরে রাতের দিকেই বিভিন্ন এলাকায় বাজি ফাটানো শুরু হতেই রাস্তায় আরও সক্রিয় হয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে পুলিশ। হাকিমপাড়া থেকে খালপাড়া, মিলনপল্লি, পঞ্জাবীপাড়া, আশ্রমপাড়া, সেবক রোড, চার্চ রোড থেকে প্রধাননগর, গুরুঙ্গবস্তি কোনও এলাকায় বাজি ফাটানোতে পিছিয়ে থাকেনি। পুলিশ দেখেই বহু পাড়ায় যুবক যুবতীদের পালিয়ে বাড়ি বা বহুতলে ঢুকে পড়তে দেখা গিয়েছে। কয়েক জায়গায় মাঠের পাশে দেওয়াল টপকে যুবকদের পালাতেও দেখা যায়। বেশ কিছু পানের দোকান, স্টেশনারি দোকানে শব্দবাজি লুকিয়ে চুরি বিক্রি চলে। কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি দুটি বহুতলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতে দেখা গিয়েছে। রাত ১১টার শব্দের জেরে খালপাড়া এলাকায় রাস্তার কুকুরদের দৌঁড়ে এ গলি ও গলিতে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতেও দেখা গিয়েছে।

Advertisement

রাতে খোদ পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ বিভিন্ন থানা এলাকায় ঘোরাঘুরি শুরু করেন। পুলিশের হিসাবে, রাতে বাজি, জুয়ার ঠেক, মদ খেয়ে ঝামেলার অভিযোগ ২৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৮ জায়গায় জোর করে চাঁদা আদায়ের মামলা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ৮০০ লিটার মদও। পুলিশ কমিশনার জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেকটাই শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। গত কয়েকদিন ২৫ লক্ষ টাকার উপর বাজি ধরা হয়েছে। প্রচুর ধরপাকড় করা হয়েছে।

জলপা‌ইগুড়ি

জলপাইগুড়িতে শব্দবাজির দাপট গতবারের চেয়ে খানিকটা হলেও কম ছিল৷ যদিও সব জায়গাতেই যে তা হয়েছে সেটা কিন্তু মানতে রাজি নন অনেকেই৷ শহরের বাবুপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, গতবারের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, শব্দবাজির দাপট ভালই ছিল৷ প্রদীপবাবুর অভিযোগ, এমনিতেই আমাদের বয়স হয়েছে৷ এখন এত শব্দ সহ্য করাই সমস্যা হয়৷ তার ওপর বাড়িতে থাকা দুটি কুকুরও থতথত করে কাঁপছিল৷ বাধ্য হয়ে আমরা এবং আমাদের কুকুর দুটি একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি৷ তাতেও রক্ষা হয়নি৷ ছুড়ে দেওয়া শব্দবাজি আমাদের ছাদেও ফেটেছে৷

পরিবেশকর্মী রাজা রাউতের কথায়, এটা ঘটনা যে গতবারের চেয়ে এবার অন্তত সন্ধ্যা বেলা থেকে একটু রাত গড়ান পর্যন্ত শব্দবাজি কম ফেটেছে৷ কিন্তু রাত যত বেশি হয়েছে ততই শব্দবাজির দাপট বেড়েছে৷ বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার শহরের প্রায় সর্বত্রই লুকিয়ে শব্দবাজি ফাটানো হয়েছে৷ রাতের দিকে দিনবাজারের কিছু এলাকা ও সমাজপাড়া লাগোয়া এলাকায় এর দাপট বেশি ছিল৷ পুলিশের অবশ্য দাবি, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই শব্দবাজি পাড়ানো রুখতে সক্রিয় ছিলেন তারা৷ জেলার বিভিন্ন জায়গায় সাদা পোশাকের পুলিশও নামানো হয়েছিল৷ সন্ধ্যাবেলার দিকে ধূপগুড়ি বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া এসাকা থেকে বেশ কিছু নিষিদ্ধ শব্দবাজি আটক হয়৷ পুলিশ সুপার অমিতাভ মাইতি বলেন, জলপাইগুড়িতে এবার শব্দবাজি দাপট আমরা রুখতে পেরেছি৷ আর সেজন্য সকাল থেকে অনেকেই পুলিশকে ফোন করে অভিনন্দনও জানিয়েছেন৷

মালদহ

একদিকে জিএসটি। অপরদিকে পুলিশের কড়া নজর। ফলে চলতি বছর শব্দবাজি কিংবা আতসবাজির প্রদর্শন উল্লেখযোগ্য ভাবে কম দেখা গিয়েছে মালদহে। তবে এবারে ফানুস বিক্রি বেড়ছে দ্বিগুন। ফলে বাজি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়লেও কালীপুজোয় লাভের মুখ দেখেছেন ফানুস বিক্রেতারা। জানা গিয়েছে, পাইকারি বাজারে প্রতি পিস ফানুসের দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর খুচরো বাজারে ফানুসের দাম প্রতি পিস৩০ টাকা।

দাম তুলনামূলক ভাবে কম থাকায় অধিকাংশ যুবকেরা ফানুসের প্রতি ঝুঁকছেন বলে জানিয়েছেন শহরের বিচিত্রা মার্কেটের ব্যবসায়ী শম্ভু বণিক। তিনি বলেন, “এবারে আমি ১২০০ ফানুস বিক্রি করেছি। বিগত বছর ৫০০ পিস বিক্রি করতেই হিমশীম খেতে হয়েছিল”। বড়ো শহর গুলির মতো আমাদের শহরের আকাশেও ফানুস উড়ানোপ প্রবণতা বাড়ছে বলে জানান তিনি। যদিও গত বছর গুলিতে কালীপুজোর রাতে অন্য ছবি দেখা যেত। শহর গ্রাম সর্বত্রই দেদার ফাটত শব্দবাজি। তবে এবারে প্রকাশ্যে সেই দূশ্য দেখা যায়নি। বিক্ষিপ্ত ভাবে শব্দবাজি ফাটলেও লাগাম ছাড়া হয়নি। এক স্কুল শিক্ষক বলেন, “বাজির উপরে ২৮ শতাংশ জিএসটি লেগেছে। তাই দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়েছে বাজি। তাই এ বারে খুব বেশি বাজি ফাটানো হয়নি।’’

রায়গঞ্জ

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রায়গঞ্জের মোহনবাটী, উকিলপাড়া, সুদর্শনপুর, শিলিগুড়িমোড়, বিদ্রোহীমোড়, সুপারমার্কেট, রাসবিহারী মার্কেট, মিলনপাড়া, বীরণগর, দেবীনগর ও কসবা এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে শব্দবাজি ফেটেছে। তবে গত বছরের মতো এবছর বিপুল পরিমানে শব্দবাজি ফাটেনি। ফলে এবছর কান ঝালাপালা হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। প্রতিবছর শহরের শিলিগুড়িমোড় থেকে বিদ্রোহীমোড় পর্যন্ত রাস্তার মাঝে বাসিন্দাদের একাংশ শব্দবাজি ফাটাতেন। এবছর বাসিন্দাদের শব্দবাজির বদলে ফানুস ও তুবড়ি ফাটাতে দেখা গিয়েছে। কালিয়াগঞ্জ, ইটাহার, হেমতাবাদ ও করণদিঘির বিভিন্ন এলাকায় শব্দবাজি ফাটলেও তা গত বছরের তুলনায় অনেকটাই কম ছিল।

পুলিশের দাবি, এবছর পুলিশ ও পুরসভার যৌথ উদ্যোগে রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ডালখোলা ও ইসলামপুরে বাজি বাজারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই বাজি বাজারের বাইরে সবরকমের বাজির কারবার নিষিদ্ধ করা হয়। তারজেরেই এবছর দিপাবলীতে শব্দবাজির দাপট কম ছিল! তাছাড়া পুলিশের টানা নজরদারি ও তল্লাশির জেরে এবছর বিহার থেকে বিপুল পরিমাণের শব্দবাজি শহরে ঢুকতে পারেনি! জেলায় বন্যার জেরে ক্ষতির আশঙ্কায় বহু ব্যবসায়ী শব্দবাজির কারবার কম করেছেন।

কোচবিহার

কালী পুজোর রাতে কোচবিহার জেলা জুড়ে শব্দবাজির অতিষ্ঠ হয়ে ঊঠলেন বাসিন্দারা। অনেকেরই অভিযোগ, সন্ধ্যের পর থেকেই কার্য়ত গোটা জেলা শহর শব্দবাজির দখলে চলে যায়। মধ্যরাত পর্য়ন্ত একই অবস্থা চলে ভোরের দিকে কিছুটা কমে আসে। তা নিয়ে রাতেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সরব হন অনেকে। শহরের বাসিন্দা শিক্ষক দিব্যেন্দু ভৌমিক বলেন, “কোচবিহার শহরে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হতেই চকলেট, বুলেটের দাপট বেড়ে যায়। অনেককেই অসুবিধেয় পড়তে হয়েছে।” প্রশাসন ও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, অভিযোগ পেলেই অভিযান চালিয়েছে তাঁরা। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার শব্দবাজি অনেকটাই কম ছিল বলে তাঁদের দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন