শেষ অঙ্কে নায়ক সেই অঙ্কই

কোথাও টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজে কান পাতা দায়। আবার কোথাও কেউ রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ছেন। ঘনঘন ধূমপান। বারবার চা। নানা অঙ্ক কষে কারও দাবি, জোট আসছে ক্ষমতায়। সেই অঙ্কেই ভুল ধরে কেউ বলছেন, সরকার গড়ছেন দিদিই। সব পার্টি অফিসই যেন এখন অঙ্কের পাঠশালা। এমনই কয়েকটি পার্টি অফিসের কয়েকটি ছবি তুলে ধরলেন কিশোর সাহা।ভাইচুং ফের শিলিগুড়ি থেকে উবে গিয়েছে নাকি! হাসতে হাসতে হিসেব দিচ্ছিলেন এক সিপিএম নেতা। একটু আগেই মেঘদূত সিনেমার উল্টো দিকে গাড়ি থেকে নামার পরে রণজিৎ হোটেলের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক কংগ্রেস নেতার সঙ্গে যিনি হিসেব বিনিময় করছিলেন। একজন মোবাইল বার করে জোটের আসনের হিসেব দিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০২:৪৯
Share:

কোচবিহারে সিপিএম কার্যালয়।

সিপিএম অফিস, শিলিগুড়ি

Advertisement

ভাইচুং ফের শিলিগুড়ি থেকে উবে গিয়েছে নাকি! হাসতে হাসতে হিসেব দিচ্ছিলেন এক সিপিএম নেতা। একটু আগেই মেঘদূত সিনেমার উল্টো দিকে গাড়ি থেকে নামার পরে রণজিৎ হোটেলের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক কংগ্রেস নেতার সঙ্গে যিনি হিসেব বিনিময় করছিলেন। একজন মোবাইল বার করে জোটের আসনের হিসেব দিলেন। তাতে ঘাড় নাড়তে দেখা যাচ্ছিল সিপিএম নেতাকে। তিনিও স্মার্ট ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখিয়ে দিলেন, আরও কয়েকটা হিসেব। আর শিলিগুড়ির অনিল বিশ্বাস ভবনের দোতলায় সেই হিসেব নিয়ে চলল ঘণ্টাখানেক। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে দিলীপ সিংহের ভাগ্য এবার খুলবে কি না, তা নিয়েও কত অঙ্ক। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য সামান্য ব্যবধানে হলেও জিতবেন, অঙ্ক কষে হিসেব এক উঠতি নেতার।

Advertisement

তৃণমূল অফিস, শিলিগুড়ি

কোথায় অঙ্ক! কীসের অঙ্ক। খাতাই যেন নেই। শিলিগুড়িতে সেবক রোডে তৃণমূলে সদর দফতরে মস্ত তালা ঝোলে দিনরাতের বেশির ভাগ সময়। দার্জিলিঙের ৩ আসন, সমতলের ৩ আসনের হিসেব মিলে গেল নাকি! দলের জেলা সভাপতি রঞ্জন সরকার বলেন, ‘‘একবার অফিসে চুরি হয়েছে, তাই লোকজন না থাকলে অফিসের দরজায় তালাই লাগানো থাকে।’’

কংগ্রেস অফিস, হাসমি চক

হাঁকডাক করতে জুড়ি নেই শঙ্কর মালাকারের। জেলা সভাপতি ও মাটিগাড়া নকশালবাড়ির বিধায়ক ও ফের প্রার্থী। সুনীল তিরকি ফাঁসিদেওয়ার বিধায়ক ও ফের প্রার্থী। শঙ্কর অনুগামী বাজারের ফর্দের মতো একটা কাগজ নিয়ে বসে বুথ ভিত্তিক হিসেব দেখিয়ে জনে জনে বোঝান, কেন ‘শঙ্করদা’ জিতে গিয়েছেন। অঙ্ক যে গোঁজামিলের নয় সেটা বোঝাতে সেখানে বসেই নকশালবাড়ির দাপুটে সিপিএম নেতাকে ফোনে ধরেন। তাঁকে বলতে শোনা যা, ‘‘দাদা সিপিএমের সব ভোট তো হাতেই গিয়েছে এটা একেবারে নিশ্চিত তো! উত্তরে শোনা যায়, ‘‘আরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেখানে বলে দিয়েছেন, তিনি এবার প্রথম কংগ্রেসকে ভোট দেবেন, সেখানে আমরা আর কোনদিকে তাকাতে পারি!’’

তৃণমূল অফিস, আলিপুরদুয়ার

‘গুটিশ যদি এবার না জেতে তা হলে ভোটের অঙ্ক আর কোনওদিন কষবেন না বলে পণ করেছেন এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা। চেয়ারে বসে এক চুমুকে ঠান্ডা চা শেষ করে মুখ মুছে বললেন, ‘‘জোট যতই হইচই করুক, আমার অঙ্ক বলছে, এক ভোটে হলেও গুটিস (আলিপুরদুয়ারের প্রার্থী তথা তৃণমূল জেলা সভাপতির ডাক নাম) জিতছে।’’ পাশ থেকে ফোড়ন দেন আরেক নেতা, ‘দাদা, বুথের হিসেব কিন্তু বলছে ১ নয়, অনেক বেশি ভোটে জয় হতে পারে।’’’ পান মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ান প্রবীণ তৃণমূল নেতা, দরজারা বইরে চলে যান। পকেট হাতড়ে পুরানো সব ভোটের হিসেব বার করে গড়গড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, নির্মল দাস কোথায়, কেন ভাল ভোট কেটে দিতে পারে, কোথায় বিশ্বরঞ্জন পিছিয়ে পড়তে পারেন। তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ান লোকজন। ভিড় বাড়ে। জয়ের আশা বাড়ে।

কংগ্রেস অফিস, আলিপুরদুয়ার

সিপিএম ও কংগ্রেসের ভোট যোগ করা হচ্ছে। যা দাঁড়াচ্ছে তাতে তো জয় জয়াকার বিশ্বরঞ্জন সরকারের। আলিপুরদুয়ারে জোটের প্রার্থী বিশ্ববাবু। কলেজ হল্টের কংগ্রেস অফিস থেকে সিপিএম অফিস সর্বত্রই হিসেব। তাঁদেরও মাথাব্যথা নির্মলবাবুকে নিয়ে। আরএসপির নির্মল দাস। সিপিএমের এক নেতাকে বলতে শোনা যায়, “নির্মলদা খুব বেশি ভোট পাবেন না। মানুষ দেবেন না।” আরেকজন বলেন, “মানুষ তৃণমূলকে হারাবে বলেই মনস্থ করেছে। এখানে তো বিশ্ববাবুই শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। সবাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকেই ভোট দেবেন।” কংগ্রেস অফিসেও গুনগুন, “সিপিএমের কত ভোট আরএসপিতে যেতে পারে?” অঞ্চল ধরে ধরে, ওয়ার্ড ধরে অনেকে হিসেব কষে ফেলছেন। তার পর কত ভোট জোটের খাতায় আসতে পারে সে হিসেবও চলছে। তৃণমূলের শক্তি কোথায় বেশি তা বের করে সেখানে মাইনাস ধরেও হিসাব হচ্ছে। কয়েকজন কর্মী তো এত হিসেব-নিকেষ নিতে পাচ্ছেন না। তাঁরা বলতে শুরু করেন, “এসব বন্ধ করে দাও। আমরা জিতব। কত ভোটে জিতব সেটা ইভিএম খুললেই বোঝা যাবে।”

তৃণমূল অফিস, কোচবিহার

কোচবিহার টাউনে লিডের কোনও আশা আছে কি? প্রশ্ন শুনেই রাগে গরগর করে উঠলেন কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রেই যেমন তৃণমূলের প্রার্থী মিহির গোস্বামীর এক অনুগামী। তাঁর অঙ্কটা এমন, “শহরে তো ৬০ হাজারের উপরে ভোট। সেখানে কত লোকসান হতে পারে।” পার্টি অফিসের মিহিরপন্থী এক নেতার অঙ্কটা অন্য। তাঁর যুক্তি, “গ্রাম দিয়ে শহরের হিসেব পুষিয়ে যাবে।” চেঁচামেচি চলছিস ঘরের আরেক কোণে। সেখানে আলোচ্য নাটাবাড়ি। মানে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের আসন। একজন রবি অনুগামী অনেক হিসেব-টিসেব কষে কাগজটা টেবিলে ছুড়ে বলে দিলেন, “বলা তো সহজ। সব লিখে রাখলাম। দেখব কে কত লিড দেয়।” কোঁদলের অঙ্কও চলছে। দিনহাটা, শীতলখুচি, মেখলিগঞ্জেও দলের মধ্যেকার গণ্ডগোলই সব গুলিয়ে দিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে অনেকের। এক কর্মী বলেন, “শীতলখুচিতে তো এক ব্লক নেতা প্রচারেই নামলেন না। আরেকজন বহিষ্কৃত হলেও তাঁর অনুগামীদের দিয়ে উল্টো ভোট করালেন।” সব মিলিয়ে কত কাটা যেতে পারে? একজন বললেন, “নির্দিষ্ট এলাকায় ওঁরা পাঁচ হাজার ভোট কাটতে পারে। অন্য এলাকায় অবশ্য পনেরোর উপরে লিড থাকবে।” দিনহাটার প্রার্থী উদয়ন গুহের কথা তো মুখে মুখে। এক কর্মী বলেন, “ওঁকে যে হারানোর সে হারিয়ে দিয়েছেন!” বলেন কি! আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে হিসেব দেন, “শেষ মুহূর্তে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। ওই নেতার ভোটেই জিতবেন।” অঙ্কের গরমিল হলে কী হতে পারে সেটা আঁচ করতে ঘনঘন ফোন করছেন রবি অনুগামীদের কেউ কেউ।

সিপিএম অফিস, কোচবিহার

এখানেও আলোচনার প্রধান বিষয় সেই রবি ঘোষের চড়! ‘রবি ঘোষ চড় কেন মারলেন?’ তা হলে কি অন্য কিছু আঁচ করছেন। ইদানিং নাকি তাঁর শরীরও ভাল যাচ্ছে না। কিসের ইঙ্গিত? কোচবিহার জেলা সিপিএম পার্টি অফিস। কী হতে পারে নাটাবাড়িতে? এক এক করে আলোচনায় আসতে থাকল একটি করে গ্রাম পঞ্চায়েতের। যা থেকে হিসেব যা দাঁড়াল, তাতে সিপিএমের কমরেডরা উল্লসিত। একজন তো আনন্দে চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন। আরেকজন ধরে ফললেন। পার্টি অফিসে বসে শীতলখুচির এক নেতাও। নুরুউদ্দিন মিয়াঁ উচ্ছ্বাস প্রকাশে ব্যস্ত। ওই বিধানসভা এলাকার ভোট নিয়ে এবারে খুব খুশি। গোলেনাওহাটি, ভাওয়েরথানা, শীতলখুচি মিলেমিশে সব গ্রাম পঞ্চায়েত করলে মেরকেটে পাঁচ হাজারের নিচে তাঁরা জিতবে না বলেই দাবি। জেলার হিসেব কী হবে! পটাপট পকেট থেকে চিরকুট বার করে ‘লিড’-এর হিসেব দিচ্ছিলেন এক নেতা। তাতে ৯ আসনের ৬টিই জোটের দখলে যায় আর কী! আরেকজন বললেন, ‘‘ধীরে ভাই। অত তাড়াহুড়ো কোরো না।’’

সিপিএম অফিস, জলপাইগুড়ি

জলপাইগুড়ির ডিবিসি রোডে সকাল এগারোটার মধ্যে চলে আসেন জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য। সন্ধ্যার পর ভিড় করেন দলের তরুণ প্রজন্ম। ডিবিসি রোডে দলের জেলা কার্যালয়ের সামনে তাদের আড্ডা চলে। তখনই ঘুরেফিরে প্রশ্ন ওঠে, বলি কত হবে? কেউ খাতা-কলম নিয়ে উত্তরের হিসেব কষে জানিয়ে দেন, ৭ জেলায় ৫৪ আসনের মধ্যে ৪৯ তো হচ্ছেই। সামনে কয়েকটি ফাস্ট ফুডের দোকানে ভিড়। উৎসাহীরাও অঙ্কে যোগ দেন। জোটের বাজারে কেন ৫৪ তে ৫০ হতে পারে সেই আওয়াজ ওঠে। এগ রোল বিক্রি হতে থাকে হু হু করে। বিক্রেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার হল ৫টা, ওঁনার ২টো।’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রোলের দোকানো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা যুযুধান দলের লোকজন।

কংগ্রেস অফিস, জলপাইগুড়ি

থানার কাছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেসের অফিস। আদালতের কাজ সেরে বেলা একটার মধ্যে চলে আসেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নির্মল ঘোষদস্তিদার। সাড়ে তিনটে পর্যন্ত থেকে বাড়ি যান। শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল জেলার সাধারণ সম্পাদক অমিত ভট্টাচার্য, যুবকংগ্রেস সভাপতি চন্দন দাস, কাউন্সিলার পরিমল মালো দাস সমেত কংগ্রেস কর্মীতে ঘর ঠাসা। আলোচনার বিষয় উত্তরবঙ্গে জোট কত পাবে এবং তৃণমূল কত পাবে। এক জন তৃণমূল কুড়িটা পাওয়ার কথা বলতে প্রতিবাদ করে উঠলেন পরিমল মালোদাস। তার প্রতিক্রিয়া, ‘দুর অত সিট পেতেই পারবে না।’

তৃণমূল অফিস, জলপাইগুড়ি

জলপাইগুড়ি শহরে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের সাত-সাতটা অফিস। ফলে, ৭ আসনের অঙ্ক কষা হচ্ছে সাত রকম কায়দায়। তবে ভোটের জন্য উকিলপাড়ায় একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় করা হয়েছে। স্টেশন রোডে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের অফিসে সন্ধ্যার পরে জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায় গেলেই ভিড় বাড়ে। সৈকতবাবুর অঙ্ক, তাঁরা আসছেনই। পাটগোলার চন্দন ভৌমিকের অফিসে এবং মোহন বসুর সাত নম্বর ওয়ার্ডেও একই আলোচনা। একই অঙ্ক। কিন্তু, একজনের হিসেব আরেক জনের সঙ্গে যে মেলে না! মার্চেন্ট রোড সংলগ্ন কল্যাণ চক্রবর্তীর অফিসের অঙ্কের উত্তরের সঙ্গে বিস্তর ফারাক অন্যদের।

(সহ প্রতিবেদন নমিতেশ ঘোষ, নারায়ণ দে, অনির্বাণ রায়, রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়)

—নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement