হাতে হাতে ঘুরছে প্লাস্টিক। শিলিগুড়ি শহরে সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
‘প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ মুক্ত শহর’-এর শিরোপা শিলিগুড়ির হাতছাড়া হওয়াটা এখন যেন সময়ের অপেক্ষা!
কারণ, একশ্রেণির নেতা-কর্তার মদতে ফের ব্যবসায়ীদের একটি চক্র ফের শিলিগুড়িকে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ দিয়ে মুড়ে ফেলতে চাইছে বলে অভিযোগ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। পরিবেশপ্রেমীদের একাংশের অভিযোগ, ‘প্লাস্টিক-লবি’র সঙ্গে প্রভাবশালী নেতা-কর্তাদের একাংশের ঘনিষ্ঠতার কারণেই মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ী পুরসভা-প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার সাহস দেখাচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, দূষণ নিন্ত্রণ পর্ষদের একাংশের সঙ্গেও ‘প্লাস্টিক-লবি’র বোঝাপড়া রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশপ্রেমীরা। সে জন্যই প্রায় পাঁচ মাস ধরে সব ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ফের পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেই। অবিলম্বে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ প্রক্রিয়া শুরু না করলে পরিবেশপ্রেমীরা লাগাতার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ঘটনাচক্রে, সোমবারই শিলিগুড়ির হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) তরফে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে গিয়ে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধ করানো নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ করা হয়েছে। কারণ, কয়েক মাস আগে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নির্মাতাদের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের গ্রিন বেঞ্চ শিলিগুড়িতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধের বিজ্ঞপ্তি নিয়ম মেনে হয়নি বলে জানিয়ে দেয়। কারণ, আবেদনকারী ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ওই বিজ্ঞপ্তি জারির আগে তাদের ডেকে মতামত নেওয়া উচিত ছিল। তাই গ্রিন বেঞ্চ নতুন করে জনশুনানি করে সব পক্ষকে (প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নিমার্তাদেরও) ডেকে মতগ্রহণের পরে বিজ্ঞপ্তি জারির নির্দেশ দেয়। সেই থেকে শিলিগুড়িতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের রমরমা শুরু হয়ে যায়।
পুরসভা ভোট পেরিয়ে গেলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষ থেকে নতুন করে জনশুনানির ব্যবস্থা করা যায়নি বলেই নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে পরিবেশপ্রেমী মহলে। খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী একাধিকবার আশ্বাস দিলেও কেন কাজের কাজ হচ্ছে না তা নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি শীঘ্রই কলকাতায় গিয়ে পরিবেশ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করবেন। প্রসঙ্গত, পুরভোটের প্রাক্কালেও তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ।
এই মুহূর্তে পুরবোর্ডে ক্ষমতাসীন বামেরা। যাদের সমর্থন করেছেন ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষ ওরফে অমুবাবু। যিনি নিজেও প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ শহরে পুরোপুরি বন্ধের পক্ষপাতি। সেই অরবিন্দবাবু বলছেন, ‘‘আমরা যে ভাবেই হোক শহরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বর্জনের প্রক্রিয়া জোরদার করব। শিলিগুড়ির বাসিন্দারা যদি স্বেচ্ছায় সব ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করেন তা হলে কারও কিছু বলার থাকবে না। সেটাই আমরা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’’
কয়েক বছর আগে উদ্যোগে শিলিগুড়ি পুর এলাকায় প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধ হয়েছিল, সেই কংগ্রেস কাউন্সিলর সুজয় ঘটক অবশ্য মনে করেন, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বর্জনের জন্য সরকারি আইনের চেয়েও প্রয়োজন পুরবোর্ডের সকলের সদিচ্ছা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যখন বোর্ড চালিয়েছি, তখন সকলে মিলে রাস্তায় নেমে ক্যারিব্যাগ বর্জনের ডাক দিয়েছি। শহরবাসীর সমর্থন নিয়ে সেটা আমরা করেছিলাম বলেই শিলিগুড়ি ‘প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ফ্রি সিটি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।’’
প্লাস্টিক নিয়ে মন্ত্রীকে নালিশ ন্যাফের। —নিজস্ব চিত্র।
এর পরে সুজয়বাবুর সংযোজন, ‘‘মনে রাখতে হবে, আমজনতা যদি বর্জন করতে রাজি হয় তা হলে শহরে একটাও প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পাওয়া যাবে না। পরিবেশ দূষণ মুক্ত রাখতে আমি কী গ্রহণ করব আর কী বর্জন করব তা আমার নিজের ব্যাপার। সে জন্য আইন কবে হবে ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা কোনও বিচক্ষণতার পরিচয় নয়।’’
পরিবেশপ্রেমীরা যাই-ই বলুন না কেন, শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের প্লাস্টিক সামগ্রী নির্মাতারা অনেকেই কিন্তু তাঁদের যুক্তিতে অবিচল। তাঁরা মনে করেন, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধ করলেই পরিবেশ দূষণ মুক্ত হয়ে যাবে এমন ভাবাটা অযৌক্তিক। বরং, তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ যাতে মাটিতে, নর্দমায় পড়ে জলের গতি না আটকে দেয় তা নিশ্চিত করলেই কাজটা সহজ হয়ে যাবে। নর্থ বেঙ্গল প্লাস্টিক সামগ্রী নির্মাতাদের ফেডারেশনের এক কর্তা তো একান্তে জানিয়ে দিয়েছেন, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পুরোপুরি শিলিগুড়িতে বন্ধ করে দেওয়ার মতো বিজ্ঞপ্তি সরকার জারি করবে বলে তাঁরা ভাবতেই পারছেন না।
কেন? সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ফেডারেশনের ওই কর্তা।
(চলবে)