রবিবারের ভূমিকম্পের পরে কোচবিহার রাজবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন পর্যটকেরা। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
অষ্টাদশ শতকে ভূমিকম্পের জেরে প্রাসাদ থেকে দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে লাফিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। এমনকী ওই দিন কম্পনের জেরে বুকে ইট পড়ে জখম হয়েছিলেন এক কর্মী বসন্ত কুমার দেববক্সি। পরে জখম ওই রাজকর্মীর মৃত্যু হয় বলে কথিত রয়েছে। সে বার রাজবাড়িটিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তিন বছর আগে ২০১২ সালে কোচবিহারে ভূমিকম্পের জেরে ওই রাজবাড়ির দেওয়াল থেকে গম্বুজ খিলানের কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ফাটল তৈরি হয়।
এ বার শনি-রবিবার পরপর দু’দিনে অন্তত তিন দফায় কম্পনের জেরে কোচবিহারের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ শতাব্দী প্রাচীন ওই পুরাকীর্তি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বাসিন্দাদের উদ্বেগ বেড়েছে। পরিস্থিতির জেরে ওই রাজবাড়ির ‘বিপদ’ এড়াতে বিশেষ ‘রেট্রোফিট’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূকম্পন পরিকাঠামো তৈরির দাবি উঠেছে। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটি ওই দাবি তুলে সরব হয়েছে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সূত্রের খবর, এ বারের কম্পনে ক্ষতি না হলেও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। কোচবিহার রাজবাড়ির কনজারভেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পঙ্কজ দাস বলেন, “এ বারের কম্পনে রাজবাড়ির কোনও ক্ষতি হয়নি। নতুন ফাটল তো দূরঅস্ত্, কোথাও চিড়ও ধরেনি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। ওই দাবির বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হবে।”
হেরিটেজ সোসাইটি সূত্রেই জানা গিয়েছে, ১৮৮৭ সালে কোচবিহার শহরের কেশব রোড এলাকায় বিশাল জায়গা নিয়ে ওই রাজবাড়ি তৈরি হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে তৈরি ওই প্রাসাদ দেখতে ফি বছর দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা কোচবিহারে আসেন। ভূমিকম্পে রাজবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির নজির থাকায় এ বার দু’দিনে পরপর তিন দফায় ভূমিকম্পের জেরে বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার দাবি জোরাল করা হয়েছে। রবিবার দুপুর নাগাদ ফের কম্পন শুরু হলে রাজবাড়ি ছেড়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসেন আতঙ্কিত পর্যটকেরা। সব মিলিয়েই ‘রেট্রোফিট’ প্রযুক্তি ব্যবহারের দাবি উঠেছে। ‘রেট্রোফিট’ প্রযুক্তি আসলে কি? তাতে কি ভূমিকম্পের বিপদ পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব? এ সব প্রশ্নও অবশ্য উঠেছে। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “তৈরির সময়ে ছিল না, এমন কিছু সামগ্রী দিয়ে নতুন করে পরিকাঠামো শক্তপোক্ত করার ওই ব্যবস্থার পোশাকি নাম রেট্রোফিট। পুরাকীর্তি সংরক্ষণেও ওই ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। পুরনো ভবনে নতুন পিলার বসান, ইটের দেওয়ালের দু’দিকে বিশেষ ধরনের স্টিলের পাত মুড়ে দিয়ে ধসে পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই এড়ানো যায়। বহু দিন থেকেই আমরা ওই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রাজবাড়ির সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছি। এ বার দু’দিন পরপর কম্পনের জেরে ফের দাবি জানান হয়েছে।”
জেলার প্রবীণ বাসিন্দা ও ইতিহাস গবেষকদের একাংশও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত কোচবিহারের রাজবাড়ি সংরক্ষণের বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছেন। কোচবিহার রাজ পরিবারের দুয়ারবক্সী অমিয় দেববক্সী বলেন, “বাবার কাছে শুনেছি অষ্টাদশ শতকে কোচবিহারে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল। সে বার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রাসাদ থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার এক দাদু রাজবাড়িতে কাজের সুবাদে সেখানে ছিলেন। প্রাসাদের ইট খুলে তাঁর বুকের ওপর পড়েছিল। সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা আধুনিক ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যে দাদু মারা যান। অথচ কয়েক বছর আগের কম্পনের রাজবাড়ির কিছু ফাটল এত দিনেও মেরামত হয়নি। যে ভাবে ঘনঘন কম্পন হচ্ছে, তাতে দ্রুত ওই সব ফাটল মেরামত করে আরও কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা ভাবা দরকার।” কোচবিহারের ইতিহাস গবেষক নৃপেন পাল বলেন, “১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের জেরে এখনকার প্রাসাদটির উত্তর দিকে একাংশ ভেঙে পড়েছিল। রাজবাড়িতে বেশ কয়েক জনের মৃত্যুও হয়েছিল। এ বার দু’দিন ভূমিকম্পের জেরে দ্রুত রাজবাড়ির সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।” রাজ্যের এক প্রাক্তন পদস্থ বাস্তুকার অমল সরখেল বলেন, “পুরনো কাজের সঙ্গে মানানসই ভাবে নতুন সংযোজন করে ওই রাজবাড়ি সংরক্ষণে রেট্রোফিট করা যেতে পারে। ওই ব্যাপারে দেরি না করে সংশ্লিষ্ট সব মহলের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”