টাকা দিতে না পারলে দুঃখ পান ব্যাঙ্ককর্মীও

নোট-এর ঘোঁট ও প্রাথমিক উল্লাসের মিঠা ক্রমশ বিষাদের তেতো হয়ে উঠেছে অনেকের কাছেই। একজন ব্যাঙ্ককর্মীর কাছে ভিন্নস্বাদের অনুভূতি। এক দিকে ক্রমশ পাল্টাতে থাকা ভিড়ের চরিত্র। প্রশ্নহীন জনতার অসীম সহ্য ক্ষমতা। অন্য দিকে, অসহায়ের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হর্ষ ও বিষাদ।

Advertisement

গৌতম গুহ রায়

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৪
Share:

নোট-এর ঘোঁট ও প্রাথমিক উল্লাসের মিঠা ক্রমশ বিষাদের তেতো হয়ে উঠেছে অনেকের কাছেই। একজন ব্যাঙ্ককর্মীর কাছে ভিন্নস্বাদের অনুভূতি। এক দিকে ক্রমশ পাল্টাতে থাকা ভিড়ের চরিত্র। প্রশ্নহীন জনতার অসীম সহ্য ক্ষমতা। অন্য দিকে, অসহায়ের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হর্ষ ও বিষাদ।

Advertisement

অন্য ব্যস্ত দিনের সঙ্গে ৮ তারিখের দুপুরটার খুব একটা তফাত ছিল না। ব্যাঙ্কের আমানতকারীদের দৈনন্দিন ভিড়ের বিশেষ কোনও হেরফের না থাকলেও এই সময়টায় ব্যাঙ্কগুলোর উপর অন্য একটা চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। রবিশস্যের দাদনের চাপ। আলুর মতো রবিশস্য চাষের ঋণ আদায় এবং দাদনের ‘পিক আওয়ার’-এ চলে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। এ সব সামলে তবুও বাড়ি ফেরার জন্য হলদিবাড়ির ডিএমইউ ধরতে পারলে মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেকের রেলযাত্রায় নিত্য দিনের সহযাত্রীদের নিয়ে হাসি হুল্লোড় খুনসুটি এবং বির্তকের মজাটাই আলাদা। রাত ৭টা নাগাদ জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে ট্রেন পৌঁছনোর পর খবরটা এসেছিল। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল।

পরদিন ৯ তারিখ ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকবে, ১০ তারিখ থেকে ব্যাঙ্কে টাকা পাল্টানো ও জমা প্রক্রিয়া শুরু হবে। টাকা তোলার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক থেকে, এটিএম থেকে, পোস্ট অফিস থেকে রেশনিং আরোপিত করা হল। টিভিতে সরগরম চর্চার মধ্যেও ব্যাঙ্ক বা ব্যাঙ্ক কর্মীদের উপর আগত অসম্ভব চাপ নিয়ে সবাই এক সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবুও তখনও বোঝা যায়নি এই চাপ এতটা বড় ও গভীর হবে। ‘আমজনতা’র স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস টের পাওয়া যাচ্ছিল কালো টাকার উপর হানা এই ‘সার্জিকাল অপারেশেন’-এ। কিন্তু প্রায় তিন সপ্তাহে সেই উল্লাস পাল্টে যাচ্ছে ক্ষোভ ও হতাশায়। বিশেষত যাঁদের মধ্যে এই উল্লাস সব চেয়ে বেশি হয়েছিল সেই অর্থশূন্য নীচের তলার মানুষদের মধ্যে। দেওয়ালে পিঠটা তাঁদেরই ঠেকে গেল।

Advertisement

বাজারে অর্থের জোগান নেই, মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে ঠেকলে বাজারের কী হাল হয়, দেশ তা দেখছে। ট্রেনের সেই বাদামওয়ালা, বিধানমার্কেটের সব্জিওয়ালা বা ফুলবাড়ি হাটের গরম জামার পশরা নিয়ে বসা রহমত আলি, এই সব দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর সংসারে ‘নোটহীন’ অন্ধকার ঘন হচ্ছে। এই টাকা লেনদেন ব্যবসার মধ্যে থাকা একজন ব্যাঙ্ককর্মীকে এই অন্ধকার নাড়া দিচ্ছে ভীষণ ভাবেই। ভোর ৫-৬টা থেকে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তি তারই কষ্টার্জিত টাকা জমা রেখেছেন, কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী রসদ নিতে পারছেন না, অযৌক্তিক ভাবে তার হাতে ২-৩ হাজার টাকা তুলে দিয়ে ব্যাঙ্ক হাত তুলে নিচ্ছে। তখন তাঁর ক্ষোভ যন্ত্রণা বিপরীতে থাকা একজন ব্যাঙ্ককর্মীও অনুভব করেন। তবে এই দীর্ঘ ‘জন-লাইন’-এ দাঁড়ানো অগুন্তি মানুষকে ধন্যবাদ। টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু ব্যাঙ্ককর্মীদের প্রতি সেই আক্রোশ উগরে দিয়ে আক্রমণমুখী হচ্ছেন না। কারণ তাঁরা বুঝেছেন, বিপরীত দিকে থাকা মানুষগুলোও অসহায় ভাবে দিন রাত এক করে চলেছেন।

চটহাটের হামিদ আলি, পেটকাটির বুলবুল রায় বা ধনসরার বাবলুরা প্রতিদিনই ব্যাঙ্কের দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছেন বুকভরা হতাশা নিয়ে। গ্রামের সমবায় সমিতি থেকে কৃষিঋণ নিয়ে তাঁরা চাষ করেন। এখন ঋণ শোধ করে নতুন ঋণ নিতে এসে অথৈ জলে পড়ছেন। না শোধ করা যাচ্ছে ঋণ। না পাচ্ছেন নতুন ঋণ পাওয়ার সুযোগ। সমবায় ব্যাঙ্ক ৫০০ এবং ১০০০ টাকায় নোট গ্রহণ করতে পারছে না। শুধু শিলিগুড়ি মহকুমাতে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক কৃষি ঋণ দিয়েছে ১৮ কোটি টাকার কাছাকাছি। এর সিংহভাগই আলুচাষে।

দেশের অধিকাংশ চাষির মতো এঁদেরও একাধিক ব্যাঙ্কে খাতা নেই, ডেবিট কার্ড তো দূর অস্ত। মাঠে পাকা ধান পড়ে রয়েছে, কিন্তু ঘরে তুলতে পারছেন না। চাষের জন্য নতুন করে জমি তৈরি হচ্ছে না। এদিকে মরসুম গড়িয়ে যাচ্ছে। একটা নির্দেশনামাই যেন সব প্রান্তিক চাষির চোখের সামনে থাকা নবান্নের সব আলোর ফুলঝুড়ি নিভিয়ে দিয়েছে। আমার মতো একজন সমবায় ব্যাঙ্ক আধিকারিকের কাছে এই সবের কোনও উত্তর নেই। শুধু আশঙ্কার কালো মেঘ ক্রমশ ছেয়ে ফেলেছে হেমন্তের আকাশ।

শেষে তাই একটি নিছক ব্যক্তিগত হতাশার কথা বলি। পেশার বাইরেও মানুষের ব্যক্তিগত আকাশ থাকে। কবিতা আমার সেই মুক্ত আকাশ। গত ১৭ নভেম্বর এমনই এক সুযোগ এসেছিল। যেখানে নানা ভাষার সাহিত্যিকদের সঙ্গে ভাবনার আদানপ্রদানের সুযোগ ছিল। ঢাকায় আয়োজিত এই আর্ন্তজাতিক ‘লিটারেরি মিট’-এ। ওই দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রকের উদ্যোগে ভিসা চলেও আসে। সঙ্গে প্লেনের টিকিটও চলে আসে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যায় ব্যাঙ্কের ছুটি। যার ফলে যাওয়া হয়নি আর। এ ছাড়াও বাংলাদেশের একটি সাহিত্য পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীতে রাখা হয়েছিল। সেই পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানেও থাকা হল না।

(লেখক জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন