জলের জেরেই নাকাল জীবন

নলকূপ জলের তলায় সাবেক ছিটের শিবিরে

রাস্তা না আলপথ বোঝার উপায় নেই। কোনওটি জলে ডুবে রয়েছে। কোনও রাস্তার উপরে এক হাঁটু কাঁদা। বাড়ির উঠোন থেকে শুরু করে কিছু বাসিন্দার ঘরের ভিতরেও একই হাল। শুধু তাই নয়, পানীয় জলের জন্য থাকা অগভীর নলকূপের অনেকটাই ডুবে গিয়েছে জলে।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ ও রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

কোচবিহার শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৭:৫৫
Share:

হলদিবাড়িতে সাবেক ছিটে ত্রাণ শিবিরের হাল এমনই। — নিজস্ব চিত্র

রাস্তা না আলপথ বোঝার উপায় নেই। কোনওটি জলে ডুবে রয়েছে। কোনও রাস্তার উপরে এক হাঁটু কাঁদা। বাড়ির উঠোন থেকে শুরু করে কিছু বাসিন্দার ঘরের ভিতরেও একই হাল। শুধু তাই নয়, পানীয় জলের জন্য থাকা অগভীর নলকূপের অনেকটাই ডুবে গিয়েছে জলে। সেই নলকূপেরই জল পানীয় হিসেবে ব্যবহার করছে তাঁরা। তাতে পেটের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিনিময়ের এক বছর হতে চললেও কোচবিহারের সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলির ওই অবস্থায় ক্ষোভে ফুঁসছেন মানুষ। তাঁদের অভিযোগ, এই এগারো মাসে ছিটেফোঁটা উন্নয়ন হয়নি। একটি রাস্তাও তৈরি হয়নি। বাসিন্দারা যে তিমিরে ছিলেন, সেখানেই রয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ওই এলাকাগুলির উন্নয়নের জন্য ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে। ওই টাকায় এলাকা উন্নয়ন হবে। কোচবিহারে জেলাশসাক পি উল্গানাথন বলেন, “সর্বত্র উন্নয়নের কাজ শুরু করা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”

Advertisement

গত বছরের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময় হয়। সেই সময় থেকেই এলাকার বাসিন্দারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে এ বারে অবস্থার পরিবর্তন হবে। আদতে তা হয়নি। বাসিন্দাদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, ছিটমহল থাকার সময় সেখানে কোনও উন্নয়নের কাজ কোনও সরকার করত না। রাস্তা থেকে শুরু করে জমিতে জলের ব্যবস্থা সব নিজেরাই করতে হত তাঁদের। সেই নিজেদের তৈরি রাস্তা দিয়েই এখনও চলাচল করতে হচ্ছে তাঁদের। ৫১টি সাবেক ছিটমহলেরই অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। মশালডাঙার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন অভিযোগ করেন, তাঁদের গোটা গ্রাম জল ও কাঁদায় ডুবে গিয়েছে। ঘর থেকে জুতো হাতে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে বেরোতে হয় তাঁদের। পাকা সড়কে ওঠে কোথাও পা পরিষ্কার করে জুতো পড়তে হয়। পানীয় জলের অবস্থা খুব খারাপ বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, “একে তো অগভীর নলকূপ। তার উপর নোংরা জলে অর্ধেক ডুবে গিয়েছে ওই নলকূপের। ফলে ওই জল খেয়ে পেটের রোগে ভুগতে শুরু করেছে মানুষ। আমাদের গ্রামেই এই মুহূর্তে ৩০ জনের উপরে পেটের রোগে ভুগছে।’’ একই অভিযোগ করেন পোয়াতুর কুঠির বাসিন্দা সাদ্দাম মিয়াঁ। তিনি জানান, তাঁদের গোটা গ্রামই প্রায় জলে ডুবে গিয়েছে। মানুষের চলাচলে শুধু নয়, খাবার তৈরিতেও অসুবিধের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, “সব থেকে বড় সঙ্কট হয়েছে পানীয় জলের। ডুবে থাকা অগভীর নলকূপের অপরিশুদ্ধ জলে খেয়ে পেটের রোগে ভুগতে হচ্ছে সবাইকে। আমরা ভেবেছিলাম এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।”

বাসিন্দারা জানান, এই অভিজ্ঞতা তাঁদের নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই এমন ভাবে জীবনযাপন করে বেঁচে রয়েছেন তাঁরা। তবে এ বারে তাঁদের আক্ষেপ, আগের বছরগুলিতে তাঁরা ছিটমহলে ছিলেন বলে কেউ উন্নয়ন করত না। এবারে সেই ছিটমহল আর নেই। তাঁরা সরাসরি দেশের নাগরিক হয়েছেন। অবস্থার পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক ভাবেই আশা করেছিলেন। নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “এক বছর একটা বড় সময়। এর মধ্যে কোনও একটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন হবে এমন আশা তো খুব স্বাভাবিক। উন্নয়ন কিছু হয়নি। মানুষ কোনও পরিষেবা পাননি।”

Advertisement

হলদিবাড়িতে জল জমছে সাবেক ছিটমহলবাসীদের ক্যাম্পের একটি অংশে। কিছুটা হলেও বিপাকে ছিটমহলবাসীরা। সাবেক ছিটমহলবাসীদের বাসস্থানের ‘এ’ অংশে ঢোকার রাস্তায় জল জমছে। যে অংশে জল জমছে সেই অংশটিতে এ-১ থেকে এ-৭ নম্বর বাসস্থান আছে। সামনের রাস্তা থেকে বাসস্থানের নিচে পর্যন্ত জল উঠছে। বাসস্থানগুলি উঁচু করে বানানো। নিচের অংশটি ফাঁকা। সেই অংশে জল জমছে। বাড়ি থেকে নামলেই জল পা পড়ছে। এ-১ নম্বর বাসস্থানের বাসিন্দা রঞ্জন রায়ের পরিবারের সদস্য রঞ্জন রায়ের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১১ জন। এ-৩ বাসস্থানের বাসিন্দা সুষেন হেমব্রমের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। দুজনেই বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে বাচ্চারা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যায়। রাস্তায় জল জমে থাকায় তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। জল নিকাশির ব্যবস্থা অবিলম্বে করা দরকার।”

হলদিবাড়ির সাবেক ছিটমহলবাসীদের ক্যাম্পের প্রশাসনিক ভবন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তা এটি। এই রাস্তাটি জলে ডুবে থাকলে সবাইকেই সমস্যায় পড়তে হয়। ছিটমহলবাসীদের ক্যাম্পের বাসস্থানের দুটি অংশ। একটি ‘এ’ অন্যটি ‘বি’। প্রতিটি অংশে ৫৩টি করে ১০৬টি বাসস্থান আছে। এর মধ্যে চারটি বাসস্থান বাদ দিলে বাকিগুলিতে ৪৭৮ জন বাসিন্দা বাস করেন। যারা ‘বি’ অংশে ধাকেন তাদের চিকিৎসাকেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার এবং প্রশাসনিক কাজে ‘এ অংশে আসতে হয়। শিশুদের খেলার মাঠটিও ‘এ’ অংশে। এখন সেই মাঠটি জলে ডুবে আছে। শিশুরা সেখানে খেলতে পারছেনা। এখানকার বাসিন্দারা সকলেই বলেন, “রাস্তাটিতে বৃষ্টিতে জল জমে গেলে সমস্যা হচ্ছে।”

বাসিন্দাদের মুখপাত্র হরি বর্মন বলেন, “প্রবল বৃষ্টিপাত হলে জল একটি অংশে জমছে। আমরা চাই অবিলম্বে নিকাশির ব্যবস্থা করা হোক।” হলদিবাড়ির বিডিও তাপস সিংহরায় বলেন, “ছিটমহলের বাসিন্দাদের ক্যাম্পের কোথাও যাতে জল না জমে তার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন