হেলদোল নেই পুলিশের

জেলায় জেলায় চাঁদা নিয়ে জুলুম

দৃশ্য এক: জাতীয় সড়কের একপাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো চারটি ট্রাক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ট্রাকগুলি দাঁড়িয়েই। সাধারণত গাড়ির যন্ত্রাংশ বিগড়ে গেলে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে মেরামতির কাজ চলে। কিন্তু মেরামতির কোনও উদ্যোগও নজরে আসেনি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০২:১৮
Share:

মাল মহকুমার ক্রান্তি ফাঁড়ির মৌলানির গ্রাম পঞ্চায়েতের বাড়ির সামনেই বিনা বাধায় চলছে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা তোলা। ছবি :দীপঙ্কর ঘটক।

দৃশ্য এক: জাতীয় সড়কের একপাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো চারটি ট্রাক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ট্রাকগুলি দাঁড়িয়েই। সাধারণত গাড়ির যন্ত্রাংশ বিগড়ে গেলে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে মেরামতির কাজ চলে। কিন্তু মেরামতির কোনও উদ্যোগও নজরে আসেনি। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কোচবিহার থেকে অসম যাচ্ছিল ট্রাকগুলি। জানা গিয়েছে, কোচবিহারের মারুগঞ্জে দাবি মতো চাঁদা না দেওয়ায় এলাকার মাতব্বরেরা ফতোয়া দেয়, ট্রাকের চাকা আর এগোবে না। সেই ফতোয়া অমান্য করার সাহস পাননি ট্রাক চালক। দাবি মেনে চাঁদা না দেওয়ায় শনিবার দিনভর চারটি ট্রাককে দাঁড় করিয়ে রাখা হল ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে। পুলিশকে বারবার জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি বলে অভিযোগ। শেষে দাবি মতো মোটা টাকা মিটিয়েই অসমের দিকে এগোনোর অনুমতি পায় ট্রাকগুলি।

Advertisement

দৃশ্য দুই: রবিবার সকাল। শিলিগুড়ির বাগরাকোট এলাকা। ছুটির দিন হলেও ব্যস্ততা একই টাউন স্টেশন লাগোয়া এই রাস্তায়। রাস্তার মাঝে যুবকদের জটলা। তার সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিকশা, পিকআপভ্যান। যুবকদের হাতে চাঁদার রসিদ। ন্যূনতম একশো টাকার নীচে চাঁদা নেওয়া সম্ভব নয় বলে জোড়াজুড়ি চলছে। একশো টাকা চাঁদা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানানোয় এক রিকশাচালককে মারতেও উদ্যত হল যুবকের দল। শেষে স্থানীয়দের হস্তক্ষেপে মধ্যস্থতা হয়। কিছুটা এগোতেই ফের আরেক দল যুবক থামিয়ে দিল রিকশা, তাদের হাতেও চাঁদার রসিদ। তাদের দাবি ৫০ টাকা। বাগারাকোট মোড় থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত কয়েক হাত দূরে দূরে রাস্তা আটকে চাঁদা তোলা চলছে বলে অভিযোগ। গত তিন দিন ধরে এমন চললেও পুলিশ পদক্ষেপ করেনি বলে দাবি বাসিন্দাদের।

দৃশ্য তিন: ভোরের আলো তখনও ফোটেনি পুরোপুরি। রাস্তার ওপরে বেঞ্চ পাতা দেখে চমকে উঠেছিলেন পণ্যবাহী ট্রাকের চালক। আচমকা ব্রেক কষে ট্রাক দাঁড়াতেই সামনে দাঁড়িয়ে যায় জনাকয়েক যুবক। তাদের হাতে চাঁদার রসিদ। রবিবার ভোরে মালদহ-নালাগোলা রুটে হবিবপুরের তেন্ডুয়া এলাকার ঘটনা। পুলিশের নজর থেকে বাঁচতে ভোর তিনটে থেকে রাস্তা আটকে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। গাড়ি চালক এবং মালিক সংগঠনের অভিযোগ শুনে দুপুর থেকে রাতভর সড়কে পুলিশের টহলদারি ভ্যান থাকে। এবার তাই ভোররাতে চাঁদার জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের।

Advertisement

দৃশ্য চার: জলপাইগুড়ি স্টেশন রোডে চাঁদা আদায়কারীরা প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল টোটোচালককে। অফিস পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে বলে ওই যুবকদের পথ ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন টোটোর সওয়ার এক তরুণী। অভিযোগ, সে অনুরোধে কান না দিয়ে উল্টে ওই তরুণীর কাছেও চাঁদা দাবি করা হয়। বিরক্ত হয়ে তিনি পুলিশে ফোন করলেও টহলদারি ভ্যানের দেখা মেলেনি। প্রায় আধঘণ্টা হেনস্থা হতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী।

কালী পুজো আসতেই কোচবিহারের অসম সীমানা থেকে শুরু করে মালদহ-শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি সর্বত্র চাঁদার জুলুমের অভিযোগ অব্যাহত। জাতীয় সড়ক থেকে শুরু করে ঘিঞ্জি গলির রাস্তা, দশচাকার পণ্যবাহী ট্রাক হোক কিংবা পিকআপ ভ্যান-টোটো চাঁদার দাবি থেকে রেহাই নেই কারও। শিলিগুড়ির বাগরাকোট, নেতাজী সুভাষ রোড, এনজেপি মেন রোডের মতো ব্যস্ত রাস্তাগুলিতে কয়েক হাত দূরে দূরে চাঁদা আদায়কারীদের দেখা যাচ্ছে। প্রকাশ্যে পথ আগলে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় চললেও পুলিশের কোনও হেলদোল নেই বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। এমনকী দাবি মতো চাঁদা না মিললে কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কোথাও আবার মারধরের হুমকি দেওয়া হচ্ছে চালককে।

কোচবিহার ট্রাক মালিক কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে মৌখিক ভাবে পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়েছে। দিন দুয়েকের মধ্যে তাঁরা জেলা পুলিশ সুপারকে ওই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়ে স্মারকলিপি দেবেন। ট্রাক মালিক সমিতির অভিযোগ, কোচবিহার থেকে অসম যাওয়ার রাস্তায় ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে দাঁড়িয়ে চাঁদা আদায় চলছে। চিলাখানা থেকে মারুগঞ্জে কয়েক জায়গায় একই অবস্থা। সমিতির সদস্যরা জানান, কোথাও ১০০ টাকা, কোথাও ২০০ টাকা এবং কোথাও ৫০০ টাকা পর্যন্ত টাকা দাবি করা হচ্ছে। দিনহাটা থেকে চৌধুরীহাট যাওয়ার রাস্তায় জুলুম চলছে। একই অবস্থা কোচবিহার মাথাভাঙ্গা যাওয়ার রাস্তায়। চ্যাংরাবান্ধাতেও চাঁদা আদায়ের জন্য ট্রাক আটকে রাখা হয় বলে অভিযোগ। কোচবিহার ট্রাক মালিক কল্যাণ সমিতির সম্পাদক মঙ্গল সরকার বলেন, “রাস্তায় গাড়ি বের করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমানে লোকসানের মুখে পড়ছি।’’

এক চাঁদা আদায়কারীকে থানায় ডেকে মুচলেকা লিখিয়েও জুলুম থামেনি ইসলামপুরে। শহরের পুরনো বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বেশ কিছু এলাকায় চাঁদা তুলছে এক দল যুবক। পুলিশের দাবি, ইতিমধ্যে রাস্তায় চাঁদা তোলার অভিযোগে এক যুবককে আটক করে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে এলাকাতে টহলদারি চলছে। তবু, শহরের রামকৃষ্ণপল্লি, আমবাগান, শ্রীকৃষ্ণপুর সংলগ্ন এলাকা, মাটিকুন্ডা সংলগ্ন এলাকা, গোয়ালপোখর সহ বেশ কিছু গ্রামের রাস্তায় চাঁদার জুলুমের অভিযোগ উঠেছে। জুলুমের কারণে আলিপুরদুয়ারে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের সংখ্যাই কমে গিয়েছে বলে দাবি। অসমগামী রাস্তায় গাড়ি আটকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। না দিলে গালিগালাজ ও মারধর চলছে বলেও দাবি। মালদহ, শিলিগুড়ি, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি উত্তর দিনাজপুর সব জেলাতেই পুলিশের দাবি, চাঁদার জুলম রুখতে কড়া নজরদারি চলছে। তার পরেও কেন ভুরুভুরি অভিযোগ উঠছে সেই প্রশ্নই তুলেছেন বাসিন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন