বালুরঘাটে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি:অমিত মোহান্ত
ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেই পৌঁছনো যায়নি। তার কারণ খুঁজতে সরকার আমলাদের পাঠিয়েছে গ্রাম বাংলায়। উত্তরের দুই জেলায় অবশ্য নোট বাতিলের ধাক্কাকেই এর কারণ হিসেবে মনে করছেন সরকারি আধিকারিকেরা। তবে সরকার এই পরিস্থিতিতে ধান বিক্রির টাকা নগদে না দিয়ে অ্যাকাউন্টে দেওয়ায় ব্যাঙ্কের ভোগান্তি হচ্ছে। তাই তাঁরা অনেকে শিবিরমুখো হচ্ছেন না বলে অভিযোগ জানাচ্ছেন অনেক চাষিই।
দুই দিনাজপুর ও মালদহে ঘোরার কথা রাজ্যের পরিবহন সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শুক্রবার দক্ষিণ দিনাজপুরে বালুরঘাটে জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও করেন তিনি। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, গ্রাম স্তরে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি সহায়ক মূল্যে ধান কিনে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অনলাইনে পেমেন্ট দিতে প্রশাসন থেকে মিনি ল্যাপটপ ও নোটপ্যাড দেওয়া হবে। আলাপনবাবু বলেন, ‘‘ফড়েদের কাছে কম দামের বদলে চাষিরা যাতে লাভজনক দামে ধান বেচতে পারেন, তাতেই উদ্যোগী হয়েছে সরকার।’’ নোট বাতিলের জেরে সমস্যার জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা যায়নি বলে তিনি জানান।
প্রশাসন সূত্রে খবর, এ বারে চালকলগুলির বদলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে সহায়ক দামে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য দফতর। তাতে চাষির ‘ছদ্মবেশে’ চালকল মালিকদের বদলে প্রকৃত চাষিরা যাতে সহায়ক দাম পান, সে জন্য জমির নথিপত্র দেখে কিসানমান্ডিতে চাষির পরিচয়পত্র তৈরির কাজ শুরু করে জেলা খাদ্য দফতর। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করতে নাজেহাল হচ্ছে প্রশাসন। এ বার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও জেলা খাদ্য দফতর এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনতে পেরেছে। সরকারি শিবিরে গিয়ে এখনও পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৪ হাজার কৃষক নাম নথিভুক্ত করেছেন।
সরকারের পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া করতে গিয়ে সময় লেগে যাওয়ায় সরকারি শিবিরে ধান বিক্রিতে উৎসাহ হারিয়ে জেলার চাষিরা ফড়েদের কাছে নগদে ধান বিক্রিতে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে সংযুক্ত কিসান সভার নেতা বিমল তরফদার দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘কুইন্টাল প্রতি ধানের সরকারি সহায়ক মূল্য ১৪৭০ টাকা। কিন্তু অনলাইনে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ধান বিক্রির টাকা পেয়ে সেই টাকা ব্যাঙ্কে তুলতে গিয়ে চাষিরা নাকাল হচ্ছেন। ফলে হাটবাজারে ফড়েদের বেঁধে দেওয়া কুইন্টাল প্রতি ১০০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা দামে চাষিরা ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’’ ধান বেচে ঋণশোধ এবং বোরো ধান চাষের প্রস্তুতি নিতে হওয়ায় সরকারি প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ চাষি উৎসাহ হারিয়েছেন বলে তাঁর দাবি। ব্যাঙ্কে যে দেরি হচ্ছে তা স্বীকার করেছেন তপনের এক গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজারও। তিনি বলছেন, ‘‘এখনও পর্যাপ্ত টাকার সরবরাহ মিলছে না। টাকার অভাবে গ্রাহকদের রোজ ২-৩ হাজার টাকার বেশি দেওয়া যাচ্ছেনা। বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি।’’
একই ছবি মালদহে। সেখানেও ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেই পৌঁছতে পারেনি প্রশাসন। এ বছর ২৫ লক্ষ ৬ হাজার মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্য থাকলেও ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৬ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে। সেখানেও অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ায় সেই টাকা তুলতে ভোগান্তিকে দায়ী করেছেন চাষিরা। এক চাষির কথায়, ‘‘অনেক সময় ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে চাষিদের মাস দেড়েক সময় লেগে যায়। সেখানে ফড়েরা নগদে লেনদেন করছে। এক সঙ্গে ৩০ কুইন্টাল করে ধান ক্রয় করছে ফড়েরা।’’ তাই সেখানেও বহু চাষি সরকারি সহায়ক মূল্য থেকে ১২০ টাকা কম দামে ফড়েদের ধান বেচে দিচ্ছেন।
ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে তার প্রভাব পড়বে খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পে। তাই রাজ্য সরকারের তরফে জেলা প্রশাসনকে দ্রুত ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সমস্যা ঠেকিয়ে প্রশাসন চাষিদের সরকারি শিবিরে আনবে কী করে? মালদহ জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ মিলন দাস বলেন, ‘‘ধান কেনার তিনদিনের মধ্যেই কৃষকদের টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে। কৃষকদের সচেতন করতে জোরদার প্রচার করতে হবে।’’