বন্যার ধাক্কায় ‘মৃত’ অর্থনীতি

ছবিটি বাঁধানো রয়েছে জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজারের একটি খাদি কাপড়ের দোকানে। দোকানের মালিক শহরের আদি বাসিন্দা। তিনি আক্ষেপ করলেন, পঞ্চাশ বছর আগেকার ছবি আর রক্ষা করা যাচ্ছে না।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৩১
Share:

স্মৃতি: ৬ অক্টোবর, ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা

সাদা-কালো ছবিটিকে ফ্রেমে বাঁধিয়েও বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না। দু’ধার দিয়ে লাল হয়ে আসছে। ছবিতে শুধু আকাশ আর জল বোঝা যাচ্ছে। জলের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অনেকে। এগিয়ে গেলে বোঝা যায় কোনও এক শহরের ছবি। বন্যার জল সেই জনপদকে গ্রাস করেছে।

Advertisement

ছবিটি বাঁধানো রয়েছে জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজারের একটি খাদি কাপড়ের দোকানে। দোকানের মালিক শহরের আদি বাসিন্দা। তিনি আক্ষেপ করলেন, পঞ্চাশ বছর আগেকার ছবি আর রক্ষা করা যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবারই সেই বন্যার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে সময়ের ছবি কালের নিয়মে ধূসর হতে থাকলেও, শহরের প্রবীণেরা বলছেন বন্যার রেশ কিন্তু জলপাইগুড়ির বুকে এখনও টাটকা। যে বন্যা শহরের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে বলে এখনও হাহুতাশ করেন অনেক শহরবাসী, তা কবে জোড়া লাগবে তার উত্তর পঞ্চাশ বছর পরেও অধরা।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষের মনে এখনও সে সময়ের দিনবাজারের ছবি ভেসে ওঠে। বড় বড় কাঠের স্তম্ভে বাল্ব ঝোলানো পথবাতি। দিনবাজারের একটা অংশ জুড়ে শুধুই অবাঙালি ব্যবসায়ীদের পাইকারি দোকান। চাল, ডাল, তেল, নুন-সহ আনাজের পসরা। দিনবাজার থেকে পণ্য যেত ডুয়ার্সে, এমনকী শিলিগুড়িতেও। দিনবাজারের পাশ দিয়েই বয়েছে করলা নদী। ১৯৬৮ সালের লক্ষ্মীপুজোর রাতে জলের তোড় ভেঙে দিল পরের পর গুদামের দরজা। কয়েকশো কুইন্টাল আনাজ নষ্ট হয়ে গেল। সে ধাক্কা সামলাতে পারলেন না ব্যবসায়ীরা। আনন্দগোপালবাবু বলেন, “ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে গেলেন। তখন তো তিস্তা করলা দুই নদীই গর্জন করে। কবে আবার বন্যা হবে! সেই ভয়ে দলে দলে ব্যবসায়ীরা শহর ছেড়ে চলে গেলেন। পাইকারি দোকানগুলি বন্ধ হয়ে গেল। থাকল শুধু কয়েকটি মুদি দোকান। সেই ক্ষতি আজও পূরণ হয়নি।”

Advertisement

স্বাধীনতার আগে থেকেই জলপাইগুড়ি শহরের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল চা এবং কাঁচামালের ব্যবসার ওপর। বন্যার ধাক্কায় কাঁচামালের ব্যবসার কেন্দ্রই সরে যায় জলপাইগুড়ি থেকে। আঘাতে গুটিয়ে যায় চা বাণিজ্যও। উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির সদর দফতর ছিল জলপাইগুড়িতে। চায়ের গুদাম ছিল। চা পাতা রাখার কাঠের বাক্সও তৈরি হতো শহরে। বন্যায় চা বাগানগুলির সব নথি ভেসে যায়। বেশ কিছু চা সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন করেই যদি অফিস তৈরি করতে হয় তবে কলকাতাতে তৈরি হবে। বারবার বন্যার আশঙ্কাও নেই। চায়ের ওপর নির্ভরকরা অর্থনীতি হয়ে গেল চা-হারা। বন্ধ হয়ে গেল যাবতীয় অনুসারি শিল্পও। ছোট চা বাগানের মালিকদের সর্বভারতীয় সংগঠনের কর্তা বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বললেন, “বন্যায় সরাসরি পুঁজির ওপর আঘাত আসে। একের পর এক বিনিয়োগ সরে যায় জলপাইগুড়ি থেকে।”

পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “সে সময় আমরা ছোট। কত মৃতদেহ টেনে বের করেছি তার হিসেব নেই।” রাশি রাশি মৃত্যু বয়ে আনা সেই বন্যা জীবন্ত এক শহরকেও মৃতপ্রায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল। তার প্রভাব এখনও চলছেই বলে মনে করেন এই শহরেরই অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন