বেপরোয়া স্কুলবাস এ বার কাড়ল প্রাণ

এ বার বেপরোয়া স্কুলবাস প্রাণ কাড়ল এক যুবকের। শহরের রাস্তায় কিছু লড়ঝড়ে স্কুলবাস চলাচলে পড়ুয়াদের সুরক্ষা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন অভিভাবকেরা, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টেয় বর্ধমান রোডের ঘটনা। যা কি না পড়ুয়া ও পথচারীদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়াল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০২:৫৯
Share:

বর্ধমান রোডে পড়ে রয়েছে দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির দেহ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

এ বার বেপরোয়া স্কুলবাস প্রাণ কাড়ল এক যুবকের। শহরের রাস্তায় কিছু লড়ঝড়ে স্কুলবাস চলাচলে পড়ুয়াদের সুরক্ষা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন অভিভাবকেরা, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টেয় বর্ধমান রোডের ঘটনা। যা কি না পড়ুয়া ও পথচারীদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়াল।

Advertisement

বৃহস্পতিবার বিকেল চারটে নাগাদ তিরবেগে ছুটে যাওয়া একটি স্কুলবাস শিলিগুড়ি বর্ধমান রোডে একটি বাইকে ধাক্কা মারে বলে অভিযোগ। ধাক্কায় বাইক আরোহী ছিটকে পড়লে তাঁর মাথা পিষে দিয়ে চলে যায় স্কুলবাসের চাকা। ঘটনাস্থলেই ওই যুবকের মৃত্যু হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। পুলিশ এসে যুবকের দেহ উদ্ধার করে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত যুবকের নাম দীপঙ্কর বণিক (২৮)। তাঁর বাড়ি শিলিগুড়ির অশোকনগর এলাকায়।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, দীপঙ্করবাবু বাইক চালাচ্ছিলেন, পেছনে বসে ছিলেন উত্তম সিংহ। তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, বাসটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে এসে বাইককে ধাক্কা মারে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাসচালক মদ্যপ অবস্থায় থাকতে পারেন। বাইককে ধাক্কা মেরে বাসটি থেমে গেলেও, যুবক প্রাণে বেঁচে যেতেন বলে দাবি। তবে বাস না থেমে যুবকের মাথা পিষে এগিয়ে যায়। বাসিন্দাদের দাবি, চালকের বাস চালানোর লাইসেন্স রয়েছে কি না, তা-ও দেখা দরকার। অন্য দিকে, বাইকে ধাক্কা মারায় বাসের গতি কিছুটা কমে যায়, তারপরে চালক বাস নিয়ে পালানোর জন্য গতি বাড়িয়ে দেয়। তাতে ঝাঁকুনিতে অনেক পড়ুয়া সিট থেকে ছিটকে পড়ে। পড়ুয়াদেরও চোট আঘাত লাগে, কয়েকজন বাসের মধ্যে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। কয়েকজন বাসিন্দা বাইক নিয়ে বাসের পিছু ধাওয়া করলেও নাগাল পাননি বলে দাবি করেছেন। দুর্ঘটনার পরে স্কুলবাস চলাচলে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। পুলিশ দেরিতে পৌঁছেছে বলেও ক্ষোভ দেখান বাসিন্দারা।

Advertisement

শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বার্মা বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার মামলা দায়ের হয়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে। চালকের লাইসেন্স ছিল কি না, অথবা বাসে যথাযথ পরিকাঠামোগত সর্তকতা ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে।’’ দুর্ঘটনার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দার্জিলিঙের জেলাশসাক অনুরাগ শ্রীবাস্তব। বেহাল স্কুলবাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। জেলাশাসক বলেন, ‘‘স্কুলবাস চলাচল নিয়ে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার বিষয়েও খবর নিচ্ছি।’’

গত সপ্তাহ ধরে শহরে স্কুলবাস চলাচল নিয়ে একের পর এক অভিযোগ উঠেই চলছে। কখনও মদ্যপ চালক স্কুলবাস চালাতে গিয়ে পরপর তিনটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন বলে অভিযোগ। কখনও বা পড়ুয়াদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময়ে মদ্যপ বাস চালককে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন বাসিন্দারা। এ দিন বিকেলে ব্যস্ত বর্ধমান রোডে দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিকেল চারটে নাগাদ ওই রাস্তা তো বটেই, শহরের সব রাস্তাতেই ট্র্যাফিকের কড়াকড়ি থাকে। সে সময় জোর গতিতে বাস তো বটেই, ছোট গাড়িও চালানো অসম্ভব বলে বাসিন্দাদের দাবি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ঝঙ্কার মোড়ের ট্র্যাফিক সিগন্যাল পার হতেই বাসটি গতি বাড়িয়ে দেয়। সামনে থাকা একটি বাইক ইন্ডিকেটার জ্বালিয়ে ডান দিকে ঘুরতে শুরু করে। সে সময়েই তীব্রগতিতে ছুটে আসা বাসটি বাইককে ধাক্কা মারে এবং আরোহীকে পিষে দেয় বলে অভিযোগ। রাস্তার যে জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে ডানদিকে ‘ইউ টার্ন’ নেওয়া যায়। সে কারণে সব যান বাহনের গতিই সেখানে কম থাকে। তবে স্কুলবাসটি কেন তীব্রগতিতে চলছিল, কেন চালক সামনের বাইকের ইন্ডিকেটর দেখলেন না, সেগুলি পুলিশের তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন বলে বাসিন্দারা দাবি তুলেছেন। বাসিন্দাদের দাবি, বাসটি যে গতিতে চলছিল, তাতে আরও বড় দুর্ঘটনা বা পড়ুয়াদেরও জখম হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

অভিযুক্ত বাস চালক পলাতক বলে পুলিশ জানিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ বাসটিকে চিহ্নিত করেছে। শহর লাগোয়া চম্পাসারির কড়াইবাড়ির ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে বাসটি যাতায়াত করত। স্কুলের তরফে একটি বেসরকারি সংস্থার থেকে বাসটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ওই বাস সংস্থাকেও চিহ্নিত করেছে পুলিশ। বাস সংস্থার মালিক বাবু ঘোষ বলেন, ‘‘চালক মদ্যপ ছিলেন না। চালকের কোনও গাফিলতিও ছিল না বলেই শুনেছি।’’ বাস চালকের যথাযথ লাইসেন্সও ছিল। বাস মালিক সংগঠনের সম্পাদক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ঘটনাটি খোঁজ নিচ্ছি।’’

বাসের পিছু ধাওয়া করেছিল নবীন অগ্রবাল। তাঁর অভিযোগ, ‘‘দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাইকের পিছনেই আমি ছিলাম। আমার সামনে ডান দিকে যাওয়ার আলো জ্বালিয়ে নিয়ম মেনেই রাস্তা পার হচ্ছিলেন তাঁরা। পিছনের স্কুল বাসটি ঝড়ের গতিতে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়।’’ রিকশাচালক তেতু নাসিরুদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘‘বাসটি এলোমেলো ভাবে চলছিল। আমার রিকশার পাশ দিয়ে এমন ভাবে বেড়িয়ে গেল আরও একটু হলে আমিও চাপা পড়তাম।’’ রথখোলার বাসিন্দা গৌতম সাহা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘এক সপ্তাহের মধ্যে দু’বার মদ্যপ অবস্থায় চালককে পাওয়া গেল। এরপরে তো বাসে বাচ্চাদের ছাড়তেই ভয় পাচ্ছি।’’ বাসে থাকা পড়ুয়ারাও দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারত বলে আশঙ্কা নর্থবেঙ্গল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সঞ্জয় টিব্রুয়ালের। ঘটনার পরই তিনি পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে ঘটনার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘যথাযথ ভাবে স্কুল বাস চালানোর ব্যবস্থা করতে প্রশাসনকে দাবি জানানো হবে।’’ এ দিনই একদল অভিভাবক শিলিগুড়ির এআরটিও-র (সহ পরিবহণ আধিকারিক) সঙ্গে দেখা করেছেন। মহকুমা শাসকের সঙ্গেও দেখা করেছেন। সূত্রের খবর, মহকুমা শাসক আজ, শুক্রবার অভিভাবকদের বৈঠকে ডেকেছেন।

স্কুলবাস চলাচল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা রয়েছে। সেই নির্দেশিকায় বাসের পরিকাঠামো সহ বাস চালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কী কী সর্তকতা নিতে হবে, তা-ও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। স্কুল বাস চালকদের ন্যূনতম পাঁচ বছরের যাত্রীবাহী বাস চালানোর অভিজ্ঞতা থাকা সহ, শারীরিক সুস্থতাও থাকতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।

চালকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথাও বলা হয়েছে। তার কোনওটাই হয় না বলে অভিযোগ। এমনকী বাস চালকদের ওপরে সংস্থাগুলি নজরদারিও চালায় না বলে অভিযোগ। সে কারণেই বারবার মদ্যপ অবস্থায় বাস চালানোর অভিযোগ উঠছে বলে অভিযোগ। তরতাজা একটি প্রাণ চলে যাওয়ার পরেও কী হুঁশ ফিরবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন