কোচবিহারের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া।
শীতলখুচির গুলিকাণ্ডের কথা স্মরণ করে মমতা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে মোদী সরকার হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। যারা গুলি করল তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিল না।’’
মমতার বক্তৃতার মাঝে দর্শক আসন থেকে কেউ উঠে কিছু বলার চেষ্টা করেন। মমতা মাঝপথে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বক্তৃতা থামিয়ে দেন। তার পরে বলেন, ‘আপনাদের একটা কথা বলি। কারও কোনও দাবি থাকতেই পারে। কিন্তু মিটিংয়ে এ ভাবে করবেন না। মিটিংটা নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারের জন্য নয়। রাস্তাঘাটে তো আপনারা আমাকে চিঠি দেন। আমি নিয়ে নিই। চেষ্টা করি যতটা সম্ভব করে দেওয়ার। কারও কোনও দাবি থাকলে আপনারা প্রশাসনকে দিয়ে দেবেন।’’ কারও কোনও অসুবিধা থাকলে ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ পোর্টালে আবেদন করার কথা বলেন মমতা।
সকলে ভয় না-পেয়ে এসআইআর প্রক্রিয়ায় নাম তোলার কথা বলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আগে নোটবন্দি করেছিল। এখন এসআইআরের নামে ভোটবন্দি করার চেষ্টা। যাঁরা মারা যাননি, তাঁদের মৃত দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিক সকলকে বলব নামটা তুলতে। হেয়ারিংয়ে যাবেন, সব কাগজ নিয়ে যাবেন।’’ সকলকে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘দলও যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। মনে রাখবেন, যুদ্ধ যখন হয় তখন সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে হয়।’’
কোচবিহারের সভায় একশো দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্রের চিঠি ছিঁড়ে প্রতিবাদ করলেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘গত পরশু দিন আমাদের একটা চিঠি দিয়েছে। তাতে শর্ত দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ত্রৈমাসিক শ্রমবাজেট দেখাতে হবে। দেখানোর সময় কোথায়? এটা ডিসেম্বর মাস। বলা হয়েছে, একটা গ্রামসভায় মাত্র ১০ জন কাজ পাবে, এটা হয় কখনও? একটা পরিবারেই তো ১০টা গরিব লোক থাকে। তার পরে বলছে ট্রেনিং দিতে হবে। বলছে জমির কাজ করা যাবে না।’’ তার পরেই মমতা কেন্দ্রের ওই চিঠি দেখিয়ে বলেন, ‘‘এই কাগজটার কোনও ভ্যালু নেই। আবার আমরা ক্ষমতায় আসব। কর্মশ্রীতে এ বার ৭৫ দিন কাজ হয়েছে। একশো দিনের কাজ বাংলাই করবে। চাই না তোমাদের ভিক্ষা।’’ মমতা হাতের কাগজ দেখিয়ে বলেন, ‘‘এটা আমার নোট, কেন্দ্রের কোনও অর্ডার নয়। আমি অর্ডারটা পড়ে দিলাম। এটা আমি ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। আমি মনে করি এটা অপমান, অসম্মান।’’
মমতার কথায়, ‘‘ওবিসি কেড়ে নেওয়ার জন্য রাম-বাম কোর্টে গিয়ে মামলা করছে।’’
কোচবিহারের সভা থেকে বীরভূমের অন্তসত্ত্বা সোনালি বিবির কথা বলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় নাগরিক। সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বিএসএফ নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিল। তার পরে শুরু হল অত্যাচার। এমনকি খেতে পাননি। আমরা তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছি।’’
মমতার কথায়, ‘‘এসআইআর করো, কিন্তু হাতে সময় নিয়ে করো। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে নাম বাদ দিতে হবে? এত দিন বাংলা থেকে দেশের নাগরিক হওয়ার পর নতুন করে আবার প্রমাণ করতে হবে দেশের নাগরিক কি না? এর থেকে অসম্মান আর কী হতে পারে?’’
মমতার হুঙ্কার, ‘‘যতই চক্রান্ত করো বাংলায় এনআরসি হবে না। আমরা এনআরসি মানি না, মানব না। ডিটেনশন ক্যাম্প হবে না। নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি কাউকে বিভেদ করতে দিই না। বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখব।’’
কেন্দ্রের থেকে চিঠি পাওয়ার কথা বলেন মমতা। সেই চিঠিতে কী কী আছে তা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘এই কাগজের কোনও ভ্যালু নেই। আমরা আবার ক্ষমতায় আসব। তোমাদের ভিক্ষা চাই না।’’ তার পরেই মমতা কেন্দ্রের নোট ছিঁড়ে দেন। মমতার কথায়, ‘‘তোমাদের ভিক্ষা চাই না। আমরা নিজের পায়ে হাঁটতে পারি।’’
মমতা বলেন, ‘‘একশো দিনের কাজের টাকা দেওয়া চার বছর ধরে বন্ধ করে দিয়েছে। আবাস যোজনা বন্ধ। গ্রামীণ রাস্তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। মনে রাখবেন ২০১১ সালের পর থেকে একশো দিনের কাজে আমরা অনেক জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। ভাল কাজ করা কি অপরাধ?’’ মমতার অভিযোগ, ‘‘আমাদের সাংসদেরা দিল্লিতে গিয়েছিলেন আন্দোলন করতে। কিন্তু সকলের নামে কেস দিয়েছে।’’
লোকসভায় বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কোচবিহারের সভা থেকে সেই নিয়ে সরব হলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বললেন বঙ্কিমদা। যেন মনে হচ্ছে শ্যামদা, হরিদা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি জাতীয় গান রচনা করেছিলেন, তাঁকে এইটুকু সম্মান দিলেন না! আপনাদের তো মাথা নিচু করে নাকখত দেওয়া উচিত জনগণের কাছে। তাতেও ক্ষমা হবে না। দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাসকে অসম্মান করেছেন।’’
তার পরেই মমতা বলেন, ‘‘রাজা রামমোহন রায়কে বললেন তিনি দেশপ্রেমী নন। ক্ষুদিরাম বসুকে সন্ত্রাসবাদী বললেন। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙলেন।’’
কোচবিহারের সভা থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট কেনার অভিযোগ করলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমি বিজেপির মতো টাকা দিয়ে ভোট কিনি না। আমি ভালবাসা দিয়ে কিনি। তাই যা দেওয়ার ভোটের আগেই দিই।’’ মমতার অভিযোগ, ‘‘ভোটের আগে উজলার নামে নাটক, চা বাগান খোলার নাটক, নতুন করে কিছু দেওয়ার নাটক? এ সব আমরা বরদাস্ত করি না।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমরা উন্নয়ন পাঁচালি তৈরি করছি। ক্ষমতায় আসার পর এক বছর আমাকে বামফ্রন্ট সরকারের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সময় দিতে হয়েছে।’’
মঞ্চে উঠে পঞ্চানন বর্মার আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন মমতা।
কোচবিহারের রাসমেলা ময়দানে সভার জন্য মঞ্চ বাধা হয়েছে। মূলত, দু’টি মঞ্চ রয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট মঞ্চে রয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা। মূলমঞ্চে এলেন মমতা। কোচবিহারে তৃণমূলের অন্দরে যে ‘দ্বন্দ্ব’ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে দলীয় নেতৃত্বকে কী বার্তা দেন দলনেত্রী, তা নজরে থাকবে স্থানীয় নেতা-নেত্রীদের।
সোমবার কোচবিহারে প্রশাসনিক সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সেই কোচবিহারেই রাজনৈতিক সভা করবেন তিনি। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) আবহে রাজবংশী অধ্যুষিত কোচবিহারে তিনি কী বার্তা দেন, সে দিকে তাকিয়ে সকলে। লোকসভা ভোটে কোচবিহার আসনটি বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। সামনে বিধানসভা ভোট। সেই ভোটে জয় ধরে রাখাই লক্ষ্য তৃণমূলনেত্রীর।