জুন মাসের শেষে যখন উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম তখন মহানন্দাকে দেখেছিলাম বড় বিপন্ন। মহানন্দার চরে সারি সারি বাড়ি তৈরি হওয়া দেখে অবাক হয়েছিলাম। চরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী একজনকে দেখে জানতে চেয়েছিলাম, বড় বন্যা এলে তাঁরা কী করবেন?
আমার প্রশ্ন ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন ‘‘বন্যায় আর কত জল হবে? বাড়ি তার থেকে ঢের উঁচুতে করেছি। নদীতে তো জলই নেই। জল আসবে কোথা থেকে?’’
সে দিনের সেই মানুষটি হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, নদীর জল তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলিতে সারা বছর জল থাকে না। আর বর্ষার সময় হুড়পার করে লক্ষ লক্ষ কিউসেক জল বয়ে এনে ভাসিয়ে দেয় গোটা উত্তরবঙ্গ। এ বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে এমনটা নয়, বৃষ্টির জলে যেমন বন্যা হওয়ার কথা তার থেকেও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে এ বারের বন্যা। মালদহ ও দুই দিনাজপুরের বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখার পর মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন,বিহারের পূর্ণিয়ায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে উত্তরবঙ্গের ইটাহার, বুনিয়াদপুর, ও মালদহ ডুবেছে। মুখ্যমন্ত্রীরএই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মহানন্দার অববাহিকাকে দেখা যেতে পারে। হিসেব অনুয়ায়ী এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৭৩৮৪ বর্গ কিলোমিটার। আর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে রয়েছে ১১৮৮৭ বর্গ কিলোমিটার। স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মহানন্দার অববাহিকা বেশি থাকার ফলে, ওপরের অববাহিকার বৃষ্টির জল মহানন্দার পথ ধরে মালদহের দিকে নেমে আসে।
অতীতে বারোমাসিয়া, বেহুলা, লখিন্দর, গোয়ারডোবা, মরা মহানন্দা, কুর্মী, প্রভৃতি ছোট ছোট অনেক নদী ছিল। নদী বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় স্পিল চ্যানেল। এই স্পিল চ্যানেল বা ছোট নদীগুলি হারিয়ে যাওয়ার কারণে মহানন্দা তার বয়ে আনা অতিরিক্ত জল ছড়িয়ে দিতে পারছে না। এ ছাড়াও নদীর পারে পাড় বাঁধ বা এমব্যাঙ্কমেন্ট থাকার কারণে মহানন্দার জল সরাসরি বেরিয়ে যেতে পারছে না নদী পথ দিয়ে। যারফলে বন্যার জল দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে।
উত্তর দিনাজপুরের ব্যাপারটা একটু আলাদা। ত্রিনাই, গান্ধার, কায়া, কুলিক প্রভৃতি নাগরের উপনদীর মধ্যে কুলিক উল্লেখযোগ্য একটি নদী। একদিকে তিস্তার জল পেয়ে নাগর কানায় কানায় ভর্তি হয়ে দুকুল দাপিয়ে বন্যা এনেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে কুলিক বয়ে এনেছে প্রচুর পরিমাণে জল। মোহনার কাছে কুলিকের জলস্তর নাগরের থেকে নীচে থাকার জন্য কুলিকের জল নাগরে প্রবেশ করতে পারে না। নদী বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় ‘হাই়়ড্রোলিক জ্যাম।’ ফলে কুলিকের জল পিছনের দিকে সরতে থাকে বা ‘ব্যাক ফ্লো’ করে। কুলিকের শাখানদীগুলো যেমন কাহালৈ, বিনা প্রভৃতি মরে যাবার জন্য নদীর জল ছড়িয়ে পড়ার কোনও পথ পায় না। ফলে কুলিকেরকুল ছাপিয়ে বন্যা হয়।
বন্যা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ নদীগুলোর উপরের অববাহিকাতে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। আর মৃত ছোট ছোট শাখানদীগুলোকে সংস্কার করে দ্রুত জলনিকাশি স্বাভাবিক পথ তৈরি করে দেওয়া। তবেই বন্যা থেকে বাঁচবে উত্তরবঙ্গ।
লেখক নদী বিশেষজ্ঞ