ষাটের দশকে শিলিগুড়ির মহিলাদের অনুষ্ঠানের একটি দুর্লভ গ্রুপ ফটো।
পুরনো শিলিগুড়ির ছবি মানেই কারও কাছে যেন মন কেমন করে ওঠা। আবার কারও কাছে কৌতূহলোদ্দীপক। কেউ আবার সেই সময়ের সারি সারি কাঠের সুদৃশ্য বাড়ির সঙ্গে একনকার ‘অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট’ শোভিত শহরের দৃশ্য তুলনা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। প্রবীণ নাগরিকদের অনুভূতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য বড়ই বেদনাদায়ক। কারণ, সেই দূষণ মুক্ত, মুক্ত বাতাসের শহরটা কেমন যেন গুমোট হয়ে উঠছে বলে মনে করেন তাঁদের অনেকেই।
শিলিগুড়ি শহরের ইতিহাস সরকারি ভাবে সে ভাবে নথিভুক্ত হয়নি কোথাও। বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, তথ্য-ছবি-ভিডিও সম্বলিত কোনও দলিল আজও তৈরি হয়নি। তবে উৎসাহীরা অনেকে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাতে ধরা পড়ছে শহরের অতীতের নানা পুরানো ছবি। যেমন, হিলকার্ট রোডের প্রায় গা ছুঁয়ে থাকা বর্ধমান রোডের কাছেই ছিল হাতিশাল। যেখানে বিশালাকায় শালকাঠের খুঁটিতে শেকলে বাঁধা থাকত হাতি। ৩টি খুঁটি। ৩টি হাতি। তা দেখতে সকাল-সন্ধ্যা কচিকাচাদের ভিড় উপচে পড়ত। পুরানো শিলিগুড়ির বর্ণনায় বারেবারেই উঠে আসে এমন অনেক ছবি। শিলিগুড়ির বিশিষ্ট নাগরিক প্রয়াত সুশীল রাহার (যিনি বেণু রাহা নামেও বেশি পরিচিত।) অপ্রকাশিত স্মৃতিচারণায় এমনই নানা তথ্যের দেখা মেলে। সেখানেই জানা যাচ্ছে, প্রায় রোজই হাতিশালের একটি হাতি মহানন্দা পেরিয়ে সুকনার জঙ্গলে চলে যেত। এটাও জানা যাচ্ছে, শহরের রোড স্টেশন মোড়ে বিশাল এক কদম গাছের নীচে ছিল গরুর গাড়ির চাকা ও সরঞ্জাম তৈরির মস্ত কারখানা। দ্বিতীয় কারখানাটি ছিল হিলকার্ট রোড এও বর্ধমান রোডের এক বড জাম গাছের নীচে। কালক্রমে রোড স্টেশন মোড়ের নাম এখন হাসমি চক। কিন্তু, প্রবীণ বাসিন্দারা এখনও রোড স্টেশন বলেই চেনে ও ডাকেন।
সত্তরের দশকে শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলের ফুটবল টিম।
মূলত সুশীলবাবুর ছেলে সুজিতবাবুর আগ্রহেই শহরের অতীতের নানা তথ্য ও ছবির সংগ্রহের একটি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। সেই সুবাদে শিলিগুড়ির বিশিষ্ট প্রবীণদের সাক্ষাৎকারের ভিডিও রেকর্ডিংয়ের কাজও চলছে। তাতে সামিল হয়েছেন শহরের সংস্কৃতি জগতের অনেকেই। প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী, লেখক ও গবেষক সৌমেন নাগ সহ অনেকেই তা লিপিবদ্ধ করার কাজে সামিল হয়েছেন। সে কাজ করতে গিয়েই সংগৃহীত হয়েছে অতীতের শিলিগুড়ির ছবির দুনিয়ার নানা তথ্যও। যে কাজে সহযোগিতা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তথা ভ্রমণ বিষয়ক লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য।
চল্লিশের দশকে শিলিগুড়ি পুরসভার
প্রথম চেয়ারম্যান জগদীশ ভট্টাচার্যের বাড়ি।
সেই বাড়ির বর্তমান অবস্থা।
সেই সুবাদেই দেখা গিয়েছে কী ভাবে বদলে গিয়েছে শিলিগুড়ির ছবির দুনিয়া। তিরিশ-চল্লিশের দশকে শিলিগুড়িতে ফটোগ্রাফি মানেই মূলত বক্স ক্যামেরা। গৌরীশঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘তিনটে ঠ্যাংয়ের উপরে একটা বক্স ক্যামেরা। মাথায় কালো কাপড় দিয়ে ‘রেডি’ বলার পরে সাটারের আওয়াজ। তার পরে উঠত ছবি। তা-ও সাদা-কালো।’’ সে সময়ে আলোকচিত্রীদের সকলের নাম-ধামা-ঠিকানার নথি এখনও সংগৃহীত করতে পারেননি গৌরীশঙ্করবাবুরা। তবে তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে মূলত স্টুডিও নির্ভর ছিল ছবি তোলানো। কোনও ছবি তুলতে হতে স্টুডিওর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই সময়ে ফটোগ্রাফার শান্তি সিংহের নামডাক ছিল বেশি। সব ভালমিষ্টির দোকানের কাছে ছিল ‘সিনহা স্টুডিও’। ধীরে ধীরে সোনা স্টুডিও তৈরি করেন শান্তিবাবুর একদা সহকারী। গড়ে ওঠে ইলোরা স্টুডিও। ছবি তোলার ব্যাপারে হরেন দত্তের বেশ সুনাম ছিল বলে গৌরাবাবুরা দাবি করেন। হরেনবাবু সেই আমলে আনন্দবাজার পত্রিকায় ছবি পাঠাতেন। সাদা-কালো ছবি তুলে তা ‘ওয়াশ’ করে কলকাতায় পাঠানোর ঝকমারি বলার নয়—মন্তব্য করেন গৌরীবাবু। তিনি জানান, যতন পালচৌধুরীও ছবি তোলার কাজে সুনাম অর্জন করেন।
ছবি সৌজন্যে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য।