বাগানের আঁধার পেরিয়ে আলোর দিশা সুবন্তীদের

কলকাতা, দিল্লি তো যাওয়া দূরের কথা। বাগডোগরা কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও কোনওদিন জীবনে ট্রেনে ওঠেননি সাহাবাদ চা বাগানের বছর কুড়ির সুবন্তী এক্কা। কলেজ থেকে কোনও মতে বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ আর চা বাগানের জীবন।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২০
Share:

কলকাতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাগানের ছেলেমেয়েরা। — নিজস্ব চিত্র

কলকাতা, দিল্লি তো যাওয়া দূরের কথা। বাগডোগরা কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও কোনওদিন জীবনে ট্রেনে ওঠেননি সাহাবাদ চা বাগানের বছর কুড়ির সুবন্তী এক্কা। কলেজ থেকে কোনও মতে বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ আর চা বাগানের জীবন।

Advertisement

আবার স্কুলের গন্ডিই পার করেননি বিধাননগরের ললিত এক্কা বা ফাঁসিদেওয়ার অলোক কুজুর। চা বাগানে পাতা তোলা এবং দিনের শেষে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ফূর্তি। সন্ধ্যায় আবার নেশার ঠেক। কিন্তু গত জুলাই মাসে হঠাৎ করে পাল্টাতে শুরু করল অলোক, সুবন্তিদের জীবন।

আদিবাসী জনজাতির ছেলেমেয়েদের সমাজের মূলস্রোতে আনার জন্য আদিবাসী নবজাগরণ নামের সংগঠন গড়ে কাজ শুরু করেন শিলিগুড়ির ঘোষপুকুরের রোমা এক্কা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেশামুক্ত সমাজ এবং পড়াশুনো, কাজের কথা বলতে থাকেন। একটি অনুষ্ঠানও হয় চটহাটে। সেখানে ছিলেন রাজ্যের অনগ্রসর কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী জেমস কুজুরও। তিনিই আদিবাসী ছেলেমেয়েদের কলকাতা নিয়ে গিয়ে বাগানের চিরাচরিত কাজের বাইরে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। রোমা এক্কাকে দায়িত্বও নিতে বলেন।

Advertisement

কাজটা সহজ ছিল না। সব শুনে, অভিভাবকেরা প্রথমেই ‘না’ করে দেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সকলেরই প্রশ্ন, ডুয়ার্সের বাগানে বাগানে যা শোনা যায়, ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তা হবে না তো! ছেলেমেয়েরা পাচার হয়ে যাবে না শহরে। হারিয়ে যাবে না তো অন্ধকারে। অনেক বোঝানো, অনেক আশ্বাসের শেষে এসেছে ভরসা। আর সেই ভরসা নিয়েই তরাই-এর বিভিন্ন বাগান এলাকার ৪০ জন ছেলেমেয়ে এখন কলকাতায় সল্টলেকে। সম্প্রতি কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চড়ে সকলে গিয়েছেন মহানগরীতে। সরকারি উদ্যোগে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে তাঁদের শেখানে হচ্ছে, জামাকাপড়ের ডিজাইন তৈরি থেকে পোশাক তৈরির কারুকার্য। টি শার্ট থেকে সালোয়ার, জামাপ্যান্ট থেকে এমব্রইডারি, আগামী ৪ মাস যুবভারতীর যুব আবাসে থেকে তাঁরা শিখবেন। ওদের মধ্যে ১৮ জন যুবক, ২২ জন তরুণী।

তরাই-এর সাহাবাদ, ডাঙাপাড়া, বিধাননগর, মরিয়মগছ, খাড়ুডাঙা, চটেরহাট, বিজলিমণি ওই ৪০ জনের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের কার্তিক বাগানের আরও ২০জন। ওদের অবশ্য ৩ মাসে সফট টয়েজ তৈরি শেখানো চলছে। গত দু’সপ্তাহে মেশিন চালানো, কম্পিউটারে ডিজাইন দেখাতে অনেকটাই সড়গড় হয়েছেন অলোক, ললিতেরা। ওঁদের কথায়, ‘‘ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। পাতা তুলতে লোক লাগলে আমাদেরও ডাকে। ব্যস এই অবধি। এর বাইরে কিছুই ভাবতে পারিনি।’’ আবার সুবন্তিদের মতো মেয়েদের কথায়, ‘‘পড়াশুনো হলে হল, নইলে বিয়ে সংসার। আর বাগান। নতুন আলো দেখছি।’’

সল্টলেকের রাজ্য সরকারের আদিবাসী উন্নয়ন সমবায় নিগমের উদ্যোগে চলছে ওই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মন্ত্রী জেমস কুজুর বলেন, ‘‘এরা চা বাগানের বাইরে কিছু জানে না, বোঝে না। সেখানে থেকেই নেশা, কুসংস্কারের জন্ম। এর থেকে এদের বাইরে নিয়ে বড় করতে হবে।’’

মন্ত্রী জানান, প্রশিক্ষণের পর বিভিন্ন সংস্থার যোগাযোগ করানো হবে, চাকরি হলে ভাল। নইলে এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে এঁরা কাজ করবেন। ঘর, ঋণ থেকে সব ব্যবস্থাই আমরা করব। বিপণনের দিকটাও দেখা হবে। আর রোমা এক্কার কথায়, ‘‘ধীরে শুরু হলেও বাগানের তরুণ প্রজন্মকে নতুন আলো দেখাতেই হবে। নইলে তো আমাদের সমাজের উত্তরণ হবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন