আতঙ্কের স্মৃতি

বিপন্ন বন্যপ্রাণ

সমস্যার মধ্যে থেকেই খুঁজতে হয় সমাধানের পথ। মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাতের কারণ কী? তা থামানোর উপায়ই বা কী? এই সংঘাতের প্রত্যক্ষ আঘাত পড়েছে যাঁদের উপরে তাঁদের অভিজ্ঞতাই বা কেমন? বন দফতরের কর্তা থেকে শুরু করে পরিবেশপ্রেমীদের এ বিষয়ে কী মতামত, খোঁজ নিলেন কিশোর সাহা। সহ প্রতিবেদনে অনির্বাণ রায়, গৌর আচার্য, সব্যসাচী ঘোষ, অরিন্দম সাহা, নমিতেশ ঘোষ ও রাজু সাহা। আজ শেষ কিস্তি। ডুয়ার্সের গজলডোবায় তিন দশকের বাসিন্দা আমি। বাড়ির থেকে পেছনে তাকালেই তারঘেরা রেঞ্জের ঘন জঙ্গল দেখা যায়। সেই জঙ্গল ডিঙিয়েই গত এপ্রিল মাসে একটি দাঁতাল হাতি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৭:০৪
Share:

প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন আসে

Advertisement

ডুয়ার্সের গজলডোবায় তিন দশকের বাসিন্দা আমি। বাড়ির থেকে পেছনে তাকালেই তারঘেরা রেঞ্জের ঘন জঙ্গল দেখা যায়। সেই জঙ্গল ডিঙিয়েই গত এপ্রিল মাসে একটি দাঁতাল হাতি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। রাত তখন বারোটা হবে। রাত নটাতেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাড়িতে আমি সেদিন একাই ছিলাম। কিন্তু অত রাতে গাছ পালার সরসর আওয়াজ শুনেই ঘুম ভেঙেছিল। জানলার সামান্য ফাঁক দিয়ে চোখ রেখেই প্রকাণ্ড দাঁতালটাকে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আস্ত একটা কালো পাহাড় আমার বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর পরেই দাঁতাল ঝপ করে আমার ঘরের দিকে ছুটে আসে।

দাঁতালের এই চেহারা দেখেই তো আমার চক্ষুস্থির। কী করব বুঝে ওঠার আগেই দাঁতালের দুই দাঁত আমার ঘরের টিনের বেড়া এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। হাতির বুনো গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে যায়। আমার হাতির মধ্যে দূরত্ব তখন মেরেকেটে ৬ ফুট। আমি আর কোথায় লুকোব ভেবে কোন কূলকিনারা না পেয়ে দেরি না করে খাটের তলায় ঢুকে পড়লাম। হাতি অনেকক্ষণ গজরাল। আমার ঘরেই খেতের ধান এনে বাঁশের ঝুড়িতে রাখা ছিল। আমার সামনেই সেই ঝুড়ির থেকে সবটা ধান খেয়ে ফেলল। সবই আমি খাটের তলা থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কতক্ষন হাতি ছিল তা জানি না। এক সময় যেন সব থেমে গেল। তাও আমি খাটের তলা থেকে বেরোতে পারিনি। বাকি রাতটা ওখানে বসেই কেটে গিয়েছিল। আজও সেদিনের ঘটনার কথা ভুলতে পারি না। খাটের তলায় না ঢুকলে আমাকে বোধহয় শুঁড়ে পেচিয়ে বের করেই নিয়ে আসত। আজও আমার হাত পা কাঁপে। সব সময় শরীর যেন দুলছে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি। ৬৬ বছর বয়সে এই অভিজ্ঞতা হবে তা ভাবতে পারিনি। আজও প্রতি রাতে দাঁতালের দুঃস্বপ্ন যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। সহজে ঘুম আসে না।

Advertisement

পদ্মাবতী বল, গৃহবধূ

এখনও হঠাৎ আঁতকে উঠি

তিস্তার চরে নলখাগড়ার বন। ইতিউতি কাশফুলের ঝোপ। সেখানেই গন্ডার লুকিয়ে থাকার খবর পেয়ে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। কয়েকটা ছবিও তুলেছি। আচমকা তীরবেগে গন্ডারটা বেরিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। ছিটকে পড়ল ক্যামেরার ব্যাগ। মুহূর্তের মধ্যে খড়্গ দিয়ে আমাকে মাটি থেকে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে পড়ায় বোধবুদ্ধি মুহূর্তের জন্য গুলিয়ে যায়। কিন্তু, বুঝে যাই প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। না হলে মারা যাব। ততক্ষণে সঙ্গী অন্য চিত্রগ্রাহকেরা চিৎকার শুরু করেছেন। গ্রামের কৌতুহলি জনতাও হল্লা জুড়ে দিয়েছেন। কয়েকটা পাথরও গন্ডারটাকে লক্ষ করে মারা হয়েছে।

তাতেই বোধহয় গন্ডারটি নলখাগড়ার বনে ঢুকে পড়ে। আমি তখন পড়ে আছি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। গ্রামের এক যুবক আমাকে কাঁধে করে জলকাদা পেরিয়ে পৌঁছে দেন রাস্তার ধারে। সেখান থেকে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে পৌঁছই প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে। সহকর্মীরা ছিলেন। পরে শিলিগুড়িতে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। বন অফিসারেরাও খোঁজখবর নেন। সুস্থ হতে লেগে যায় প্রায় তিন মাস। এখনও মাঝেমধ্যে পায়ে ও কোমরে এমন তীব্র শিরশিরানি হয় যে আঁতকে উঠি। সব সময় ভাল করে বসতে পারি না। কিন্তু, কাজটা তো করে যেতেই হবে। উপায় কী! অনেকে বলেছিলেন, ঝুঁকিটা বেশি নিয়েছিলাম। আমাদের কাজটাই তো ঝুঁকির। বিনা ঝুঁকির কাজের মানসিকতা থাকলে কি আর ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম!

দীপঙ্কর ঘটক, আনন্দবাজারের চিত্রগ্রাহক

শিলিগুড়ি লাগোয়া সুকনায় রাস্তায় চলে এসেছে বুনো হাতি।

খাস শিলিগুড়ি শহরে বন থেকে এসে দাপাচ্ছে হাতি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন