হারিয়ে গিয়েছে দং, জমপৈ বর্ষার জল ধরে রাখা হবে কী ভাবে

এক সময় রাজ্যের মোট জলের ৬০ শতাংশ ছিল উত্তরবঙ্গে। তিস্তা, জলঢা়কা, তোর্সা, রায়ডাক, মহানন্দা— পাঁচ নদীর অববাহিকা ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গ জুড়ে। তবু আজ বাংলার এই অংশকে ভুগতে হচ্ছে জল কষ্টে।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ০৭:৫৯
Share:

জল চাই, কিন্তু জল পাই কোথায়!

Advertisement

এক সময় রাজ্যের মোট জলের ৬০ শতাংশ ছিল উত্তরবঙ্গে। তিস্তা, জলঢা়কা, তোর্সা, রায়ডাক, মহানন্দা— পাঁচ নদীর অববাহিকা ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গ জুড়ে। তবু আজ বাংলার এই অংশকে ভুগতে হচ্ছে জল কষ্টে।

সারা বছর ধরে এই নদীগুলো যে পরিমাণ জল বয়ে আনে, তার ৭০ শতাংশ আসে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। বস্তুত, ভরা বর্ষায় প্রচুর জল বুকে নিয়ে এই নদীগুলো দু’কুল ছাপিয়ে বন্যা আনে দুপাশের বসতির জন্য। আর বন্যার পরে যখন শুখা মরসুম আসে, তখন এই নদীগুলোই হয়ে যায় জলহারা। কেন? কারণ, এত বৃষ্টি আর বন্যার পরেও জল ধরে রাখার কোনও পরিকাঠামো নেই উত্তরবঙ্গে।

Advertisement

স্বভাবতই এখন প্রশ্ন ওঠে, অতীতে কি জল ধরে রাখার পরিকাঠামো ছিল? উত্তরটা ইতিবাচক। আমাদের পিতৃপুরুষরা বুঝেছিলেন, বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারলে শুখা মরসুমে সঙ্কট এড়ানো যাবে। তাই তাঁরা তৈরি করেছিলেন পুকুর, দিঘি, দাং, জামপৈ-এর মতো জল সংরক্ষণ পদ্ধতি। একসময় পুকুর, দিঘি নির্মাণ করে এখনও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন মহীপাল, রাঘব রায়, রানি ভবানী, পীর খানজাহান আলিরা।

বর্তমানে এই পুকুর-দিঘির সংখ্যাই কমে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গে। ২০১৫ সালে রাজ্য মৎস্য দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যাচ্ছে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ জেলা মিলিয়ে মজে যাওয়া পুকুর ও দিঘির আয়তন যথাক্রমে ৫.৭, ২৭.২, ৪৪.৬, ৬৬.১ বর্গ কিমি। আর দং বা জামপৈ-এর তো দেখাই মেলে না।

দাং দেখা যেত মূলত শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়িতে। মাত্র তিন দশক আগেও কিন্তু দাং-এর দেখা মিলত। মূলত মৃত ঝোরাগুলোকে ব্যবহার করে দাংগুলো নির্মাণ করা হতো। এগুলি মাটি ও পাথরের তৈরি সরু নালা বিশেষ। বর্ষার সময় যখন মৃত ঝোরাগুলোতে জল আসত, তখন ঝোরার জল দাং-এর মধ্যে দিয়ে চাষের জমিতে পৌঁছে যেত। ঝোরার জল যাতে সহজেই ভেতর ঢুকতে পারে, তার জন্য দাং-এর মুখগুলো চওড়া করা হতো। এক একটা ঝোরা অনেকগুলো দাংকে জল জোগাত। এখন দাংগুলোর কোনও অস্তিত্বই আর নেই।

আকার, আয়তন ও নির্মাণের দিক থেকে দাং-এর একেবারে উল্টো ছিল জামপৈ। সারা বছর ধরে জল প্রবাহিত হয়, এমন বড় নদীর বুক জুড়ে পাথর-মাটি-বালি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হতো। বাঁধগুলো দেখতে হতো উটের পিঠে থাকা কুঁজের মতো। এগুলির উচ্চতা হতো ৫ থেকে ৬ ফুট। এগুলিই জামপৈ। বাঁধের ওপরের অংশের পাশ থেকে ১২ থেকে ১৪ ফুট চওড়া খাল কেটে চাষের জমিতে জল নিয়ে যাওয়া হত। কুমারগ্রাম, জয়ন্তী, কালচিনি, রাজভাতখাওয়া প্রভৃতি জায়গায় এক বা একাধিক জামপৈ দেখা যেত। জামপৈগুলো হতো প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার লম্বা। পথ ছিল গ্রামের মধ্যে দিয়ে।

জামপৈ-এর ক্ষেত্রে যে হেতু নদী বুকে ছোট পাথর ও মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হতো, সে হেতু নদীর গতিশীল ভারসাম্যের ক্ষতি হতো না। জামপৈগুলো সারা বছর ধরে প্রচুর জল ধরে রাখত। অনেক সময় বড় বন্যা হলে জামপৈ ও জামপৈ খালগুলো ভেঙে যেত। বন্যার পরে গ্রামের মানুষ সংঘবদ্ধ হতেন। কয়েকটি কর্মদিবস ব্যয় করে জামপৈ খাল ও জামপৈয়ের মেরামতি করতেন। এই ভাবেই তৈরি হতো সামাজিক ঐক্য ও জলের প্রতি ভালবাসা।

দিনে দিনে মানুষ এই পদ্ধতিগুলো নষ্ট করে ফেলল। উত্তরবঙ্গের মাটিতে বালির ভাগ বেশি। কাজেই বৃষ্টি মাটিতে পড়লেই তা সহজে পৃথিবীর পেটে চলে যেত। বিভিন্ন কৃত্রিম কারণে উত্তরবঙ্গের মাটির চরিত্র সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কার্যত এখন আর খুব সহজে বৃষ্টির জলের মাধ্যমে পৃথিবীর পেটের জল সমৃদ্ধ হয় না। বিগত ১০০ বছরের বৃষ্টিপাতের পরিমাণকে বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, উত্তরবঙ্গে বৃষ্টিপাতের কোনও ঘাটতি হয়নি। কিন্তু জল ধরে রাখার পরিকাঠামো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উত্তরবঙ্গ জল ধরে রাখতে অক্ষম। তাই বর্ষা শেষ হলেই সেই জলের হাহাকার।

লেখক নদী বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন