ফুলবাড়ি ক্যানালে
কোথাও দিনরাত যথেচ্ছ মাছ ধরা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কোথাও নদীর পাড়ের জায়গা দখল করে জনবসতি গড়ে ওঠায় বেড়ে চলেছে দূষণের মাত্রা। আবার কোথাও চোরাশিকারিরা সুযোগ পেলেই গুলতি, তির, ঘুমের ওষুধ মেশানো মাংস মিশিয়ে বেলেহাঁস মারছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এতেই নাকি উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জলাভূমি থেকে ক্রমশ মুখ ফেরাচ্ছে দেশ-বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা। সাম্প্রতিক পাখিগণনার পরে সমীক্ষকদের তরফে এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এ হেন উদ্বেগের কথা রাজ্য সরকার তো বটেই, বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির কাছেও জানিয়েছে সমীক্ষার দায়িত্বে থাকা হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)। সংস্থার কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘এবার পাখিসুমারিতে যে তথ্য-পরিসংখ্যান মিলেছে তা ভীষণ উদ্বেগের। বিশেষ করে, রসিকবিল, ফুলবাড়ি ও গজলডোবায় পরিযায়ীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফুলবাড়ি ব্যারাজে তো গতবারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক পাখি এসেছে।’’
ন্যাফ রাজ্যের কাছে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে। তাতে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, রাতদিন মাছ মারা হচ্ছে বলে পাখির খাবার কমছে। দ্বিতীয়ত, নদী-ব্যারাজের ধার দখল হচ্ছে বলে তীরভূমির আশ্রয় হারাচ্ছে জলজ প্রাণী নির্ভর পাখিরাও। তৃতীয়ত, দখলদারদের মলমূত্র, ব্যবহৃত জঞ্জালে নদী, ব্যারাজের জল দূষিত হচ্ছে। তাতেই উত্তরবঙ্গে বেশির ভাগ জলায় পাখি আসা কমছে বলে ন্যাফের মত।
তবে আশার আলোও দেখা গিয়েছে সমীক্ষায়। কারণ, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের গভীরে যে নারারথলি জলাশয়, সেখানে কিন্তু পরিযায়ী পাখির সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। ওই এলাকায় বন দফতরের কড়া নজরদারি যেমন রয়েছে, তেমনই স্থানীয় বাসিন্দারাও নারারথলির আশেপাশে পিকনিক করতে যান না। এমনকী, কেউ জলাশয় দেখতে গিয়ে যাতে হইচই না বাঁধান, সে দিকেও নজর রাখেন বাসিন্দারা। সমীক্ষকরা দেখেছেন, কোচবিহারে রসিকবিলে ঠিক উল্টো ঘটনা দেখা যায়। সেখানে শীতের সময়ে রোজ গড়ে কয়েকশো জন পিকনিক করতে গিয়ে তুমুল হট্টগোল বাঁধান।
গজলডোবায় পিকনিক বন্ধ থাকলেও ‘ভোরের আলো মেগা ট্যুরিজম হাব’-এর নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণ শ্রমিক, ঠিকাদার, নির্মাণ সামগ্রীর ট্রাক, টেম্পো, ট্রাক্টর, সব মিলিয়ে দিনে তো বটেই, রাতেও বেশ হই-হট্টগোল হচ্ছে বলে পরিযায়ীরা গজলডোবা থেকেও মুখ ফেরাচ্ছে বলে পরিবেশপ্রেমীদের ধারণা।
এই সমীক্ষার কথা জেনেছেন বনমন্ত্রী বিনয় বর্মণ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এবং পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবও। তিন মন্ত্রীই পৃথকভাবে জানিয়েছেন, নবান্নের সঙ্গে আলোচনার পরে পদক্ষেপ করা হবে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, ‘‘রসিকবিল শুধু নয়, জলাশয় লাগোয়া এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখতে সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে সমন্বয় রেখে কাজ করতে হবে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।’’
কিন্তু, নেতা-মন্ত্রী-আমলারা উদ্বেগ প্রকাশ করলে কতটা কাজের কাজ হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। যথেচ্ছ মাছ মারা, বেলে হাঁস শিকার বন্ধ করা, নদী-ব্যারাজের আশেপাশের জায়গা দখল রুখতে সরকারি তরফে দ্রুত কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।