নদী এক পাড়ে উপচে পড়লেই, বালি বস্তা, বাঁশ, মাটি ফেলে তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে ছোট বাঁধ। আর তার ফলে বিপরীত পাড়ে ভাঙন শুরু করছে বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী। এই প্রবণতায় রাশ টানতে উদ্যোগী সেচ দফতর।
নদীতে যথেচ্ছ ভাবে মাটির বাঁধ নির্মাণ, পাড় বাঁধাইয়ের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে সেচ দফতর। দফতরের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও নদীতে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ-ই বাঁধ তৈরি করতে পারবে না বলে নির্দেশ জারি হতে চলেছে। একই ভাবে নদীর পাড় বাঁধাই করতে হলেও সেচ দফতরের অনুমতি নিতে হবে। দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, কোনও রকম পরিকল্পনা ছাড়াই নদীতে বাঁধ তৈরি করলে অথবা পাড় বেঁধে দিলে হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। বর্ষায় নদীতে জল বাড়তে শুরু করলে, স্রোতের ধাক্কায় খুব সহজেই সেই সব মাটির বাঁধ ভেঙে গিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। আবার যতদিন পর্যন্ত সেই বাঁধ অটুট থাকে, ততদিন অপরিকল্পতি ভাবে গড়ে ওঠা সেই সব বাঁধে নদীর জল ধাক্কা খেয়ে কিছুটা দূরে অথবা ওই বাঁধের উল্টো দিকের গ্রামে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে। নদীর স্বাভাবিক গতি আটকে দেওয়াতেই এই পরিস্থিতি হয় বলে দফতর জানিয়েছে। সে কারণেই এই নিয়ন্ত্রণ বলে জানানো হয়েছে।
সেচ মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “চলতি বছরে উত্তরবঙ্গে যে সব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার অনেকগুলিই অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি ছোট বাঁধের জন্য। বাঁধ তৈরি করা সেচ দফতরের কাজ। অন্য কোনও দফতর বাঁধ তৈরি করতে চাইলে সেচ দফতরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ বিষয়ে দ্রুত সকলকে জানানো হবে।”
চলতি বছরেও কুমারগ্রাম, শালকুমার, বানারহাট, ধূপগুড়ি এবং মালবাজারের বেশ কিছু এলাকায় এই ধরণের বাঁধের জেরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সেচ দফতর জানিয়েছে। সম্প্রতি তুরতুরি নদীর ‘বাঁধ’ ভেঙে গিয়েছে বলে কুমারগ্রামের ঘোকসা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের তরফেও ত্রাণ, উদ্ধারের প্রস্তুতি শুরু হয়, সর্তকতা জারি করতে কুমারগ্রামের কিছু এলাকায় মাইকে ঘোষণাও শুরু হয়ে যায়। ঘটনার খবর পেয়ে বিস্মিত হন সেচ দফতরের আধিকারিকরা। ওই এলাকায় তেমন কোনও ‘বাঁধ’ থাকার কথা দফতরের নথিতে নেই বলে জানানো হয়। খোঁজখবর করে জানা যায়, স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে নদীর পাড়ে মাটির ছোট ‘বাঁধ’ তৈরি করা হয়েছিল। যার উচ্চতাও বড়জোর ৩-৪ ফুট। জলস্রোতে সেই নড়বরে বাঁধ ধসে পড়েছে। একই ভাবে মালবাজারের লিজ, ঘিস ধূপগুড়িতে কলি, তিতাস, ডুডুয়া এবং কোচবিহারে তোর্সা নদীতে ফি বছর সামান্য বৃষ্টি হলেই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত বাঁধ বলেই সেচ দফতর মনে করছে।
কেন উদ্বেগে সেচ দফতর? নদী-বিজ্ঞান অনুযায়ী স্বাভাবিক গতিতে কোনও নদীকে বইতে না দিলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি অনিবার্য বলে দফতরের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। দফতরের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, বন্যা রুখতে সব নদীতেই বাঁধ দিতে হয়। যদিও নদীর পুরো এলাকায় বাঁধ দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে বেশ কিছু এলাকায় পরিকল্পনা করেই নদীতে বাঁধ না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেওয়া হয়। ফি বছর বন্যায় এই এলাকাগুলি দিয়ে জল বইতে পারায় নদীর অন্যত্র বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। যদিও এই এলাকাগুলিতেই পঞ্চায়েত বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাঁধ তৈরি করে দেওয়ায় বাড়তি জল বাঁধা পেয়ে আশেপাশের গ্রামগুলিতে ঢুকে পড়ছে বলে অভিযোগ।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক সুবীর সরকার বলেন, “নদীর স্বাভাবিক গতি যদি সর্বত্র রোধ করে দেওয়া হয়, তবে হয় নদীটি শুকিয়ে যাবে নয়ত প্রতি বছর বন্যা তৈরি করে আশেপাশের সব গ্রাম ভাসিয়ে দেবে। সেচ দফতর ছাড়া অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের কাছে বাঁধ তৈরির প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নেই।” স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি মেনেই এই ধরণের বাঁধ তৈরি করতে বাধ্য হয় বলে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন। উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান গৌতম দত্তের কথায়, “আমরা তো বাঁধ তৈরি করতে পুরোপুরি নিষেধ করছি না। কোন এলাকায় বাঁধ তৈরি করতে হবে এবং কীভাবে তৈরি করতে হবে তাই জেনে নিতে বলা হচ্ছে।”