যাযাবরের চিন্তায় দিন কাটান ৯৫-এর শচীন

মাছের নানা পদের টানে তিন যুগ ধরে তাঁর দোকানে ছুটে যান মানুষ৷ কিন্তু আর কত দিন? এখন সেটাই চিন্তা নবতিপর শচীন চক্রবর্তীর৷ জলপাইগুড়ির জেলাশাসকের দফতরের কাছে ছোট্ট ঘরটিতে বসে বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘আমার ব্যবসায় ছেলেদের আগ্রহ নেই৷

Advertisement

পার্থ চক্রবর্তী

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৭ ০২:৩৭
Share:

হেঁসেল: শচীন চক্রবর্তীর হোটেলে রান্না চলছে। নিজস্ব চিত্র

মাছের নানা পদের টানে তিন যুগ ধরে তাঁর দোকানে ছুটে যান মানুষ৷ কিন্তু আর কত দিন? এখন সেটাই চিন্তা নবতিপর শচীন চক্রবর্তীর৷ জলপাইগুড়ির জেলাশাসকের দফতরের কাছে ছোট্ট ঘরটিতে বসে বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘আমার ব্যবসায় ছেলেদের আগ্রহ নেই৷ আমি মরে গেলে হোটেলটা হয়তো বন্ধই হয়ে যাবে৷’’

Advertisement

ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা থাকলেও বর্তমান সময়ে তার প্রভাব হোটেলে পড়তে দিতে রাজি নন শচীনবাবু৷ তাই তিন যুগ আগে যেভাবে শুরুটা করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আজও হোটেলের জন্য নিজের হাতে চার-পাঁচ ব্যাগ ভর্তি বাজার করে যান তিনি৷ রান্নায় যাতে এতটুকু খুঁত না থাকে, সেজন্য রান্না ঘরের ভেতরে চলে তাঁর কড়া পর্যবেক্ষণ৷ শচীনবাবুর কথায়, ‘‘আসলে এই ব্যাবসাটা খুবই নোংরা, বুঝলেন৷ রান্না একটু খারাপ হলেই লোকে গালাগালি দেয়৷’’

তা এই ‘নোংরা ব্যবসায়’ এলেন কেন তিনি? শচীনবাবু জানালেন, এক সময় তিনি বায়ুসেনায় চাকরি করতেন৷ ১৯৮১ সালে সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর বেঙ্গালুরুতে একটি চাকরিও পান৷ কিন্তু বহু বছর পরিবার-পরিজনদের থেকে বাইরে থাকার পর আর ইচ্ছে হয়নি সেই চাকরিতে যোগ দেওয়ার৷ তারপর ওই বছরেই জলপাইগুড়ির জেলাশাসকের দফতরের কাছে ওই ঘরে একটি পাইস হোটেল করেন তিনি৷ নাম দেন যাযাবর৷ শচীনবাবুর কথায়, ‘‘প্রথম প্রথম খদ্দেরের জন্য তাকিয়ে থাকতে হতো৷ কোনওদিন একজন-দুজনের বেশি খদ্দের আসতো না৷ কিন্তু আজ সেই হোটেলই জলপাইগুড়ি তো বটেই, এমনকী উত্তরবঙ্গেরও বেশ কিছু জায়গায় আলোচনায় উঠে এসেছে৷’’ দুপুর বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত – মাত্র তিন ঘন্টায় প্রচুর লোক ভিড় জমান সেখানে৷ তারপর দোকান বন্ধ৷

Advertisement

নানা কাজের প্রয়োজনে যারা জলপাইগুড়িতে আসেন মূলত, দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য তাঁদের ভিড়টাই বেশি হয় যাযাবরে৷ এ ছাড়া কোনও অফিসের কর্মীদের কোন স্পেশাল খাওয়া – বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারও ঠিকানা যাযাবর৷ কর্মসূত্রে জলপাইগুড়ে থাকা কোচবিহার রবীন্দ্রভবন এলাকার বাসিন্দা দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘খাবার দামটা একটু বেশি ঠিকই, কিন্তু মাছের সাইইজগুলি দেখলেই কেন জানিনা মনটা ভরে যায়৷ মণ্ডলঘাট এলাকার বাসিন্দা শ্রীমতচন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘যাযাবর হোটেলে এত খেয়েছি, কিন্তু কোনদিনই পেটের গোলমাল হয়নি৷’’

যা শুনে শচীনবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘হবেটা কী করে? সে জন্যই তো এই বয়সেও আমি নিজে হাতেই বাজারটা করি!’’ নব্বই পেরনো শচীনবাবুকে চেনেন বাজারের সকলে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার একটাই লক্ষ্য, মানুষকে ভাল করে খাওয়ানো৷ সে জন্যই বাজারে গিয়ে সবচেয়ে দামি জিনিসগুলি বেছে বেছে কিনি৷ বাংলাদেশের ইলিশ যদি বাজারে না পাই, তাহলে সে দিন হোটেলে ইলিশের পদ রান্না বন্ধ৷ মানুষ ভাল খাবারটা পায়। সে জন্যই হয়তো একটু বেশি দাম হওয়া সত্ত্বেও আমার হোটেলে বারবার ছুটে আসেন৷’’

তবে শচীনবাবুর আক্ষেপও রয়েছে৷ এখন সব ভাল জিনিসগুলি কেমন যেন বাজার থেকে হারিয়ে গিয়েছে৷ তবে এর থেকেও তার বেশি চিন্তা তিন যুগের যাযাবরকে নিয়ে৷ তাঁর দুই ছেলের একজন স্কুল শিক্ষক৷ আরেক ছেলে হার্ডওয়্যার ও ফার্নিচারের ব্যবসায় ব্যস্ত৷ তিনি বলছেন, ‘‘এই ব্যবসায় কারও আগ্রহ নেই৷ আমার মৃত্যুর পর তাই হয়তো বন্ধই হয়ে যাবে যাযাবরের পথ চলা৷’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন