অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু শিলিগুড়ির প্রদীপের

ছিপছিপে শরীরের পরোপকারী প্রদীপ সরকারকে তাঁর ব্যবহারের জন্য লেক ফ্লোরেন্স আবাসনের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই চেনেন। কেউ কোনও সমস্যায় পড়লেই ডাক পড়ত ৩০ বছরের যুবক প্রদীপের। তা সে ফ্ল্যাটে ইলেকট্রিকের কাজ হোক অথবা বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন। গত শনিবার বিকেলে ওই আবাসনের একটি ব্লকে ১৪ তলায় আগুন লাগার খবর পেয়েই তা নেভাতে লিফটে করে উঠেছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০২:৪৮
Share:

প্রদীপ সরকার।

ছিপছিপে শরীরের পরোপকারী প্রদীপ সরকারকে তাঁর ব্যবহারের জন্য লেক ফ্লোরেন্স আবাসনের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই চেনেন। কেউ কোনও সমস্যায় পড়লেই ডাক পড়ত ৩০ বছরের যুবক প্রদীপের।

Advertisement

তা সে ফ্ল্যাটে ইলেকট্রিকের কাজ হোক অথবা বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন। গত শনিবার বিকেলে ওই আবাসনের একটি ব্লকে ১৪ তলায় আগুন লাগার খবর পেয়েই তা নেভাতে লিফটে করে উঠেছিলেন। কিন্তু আর নামতে পারননি শিলিগুড়ির বাঘা যতীন কলোনির ওই যুবক। আগুনে, ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে তিনি মারা যান বলে তাঁর পরিবারের লোকেরা জেনেছেন।

মুম্বইয়ে পওয়াই এলাকায় চান্দিভ্যালি ফার্ম রোডে ওই আবাসন তৈরির সময় থেকেই বিদ্যুতের কাজে সহায়ক হিবাসে বাস্তুকারদের সঙ্গে তিনি কাজ করতেন। বাবা অমরবাবুর কাছ থেকেই কাজ শিখে তা পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন প্রদীপ। ২০০৯ সাল থেকেই মুম্বইতে কাজ করতে যাওয়া। ওই আবাসন তৈরির পরেও সেখানে থেকে গিয়েছিল শিলিগুড়ির ছেলে প্রদীপ। আবাসনের ফেজ থ্রি ব্লকে ইলেকট্রিকের কাজকর্ম দেখভাল করতেন তিনি। পাঁচ, ছয় মাস পরে শিলিগুড়ির বাড়িতে ফিরতেন পরিবারের কাছে।

Advertisement


প্রদীপবাবুর শোকার্ত মা, বাবা। —নিজস্ব চিত্র।

গত ডিসেম্বরে শিলিগুড়িতে ফিরে বিয়ে করেছেন প্রদীপ। বিয়ের পর কিছু দিন বাড়িতে থেকে কাজের জন্য ফের মুম্বইতে চলে গিয়েছিলেন। ফেরার কথা ছিল আগামী ১৭ জুন। সেই মতো ১৫ জুন মুম্বই থেকে ট্রেনেরও টিকিট কাটা ছিল। বাড়িতে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন স্ত্রী, বাবা, মা পূর্ণিমাদেবী। কিন্তু শনিবার রাত ১১টা নাগাদ ছেলের মোবাইল থেকে বাড়িতে মায়ের মোবাইলে ফোন এলেও অন্য কন্ঠস্বর শুনেই মনটা অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠেছিল। অমরবাবু বলছিলেন, ‘‘এত রাতে ছেলে সাধারণত ফোন করে না।’’ ফোনটা ধরেছিলেন তিনিই। অচেনা কন্ঠস্বর শুনেই জানতে চাইলেন কী ঘটেছে? যিনি ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন, তিনি হিন্দিতে বলছিলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে আপনার ছেলের। আবাসনে আগুন লেগেছে। টিভি চ্যানেল খুলে দেখুন, খবরে দেখাচ্ছে। সেখানে বাসিন্দাদের বাঁচাতে গিয়েছিলেন প্রদীপ। ওর দুর্ঘটনা ঘটেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’

তখনই টিভি খুলে দেখেন আগুন লাগার খবর। টাকা জোগাড় করে পরদিন বিমানে রওনা দেন বাবা অমরবাবু। সেখানে গিয়ে সব শুনে তিনি হতবাক। আবাসনের সকলেই প্রদীপের মৃত্যুতে শোকাহত। আবাসন এবং পুলিশ প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ১৪ তলায় আগুন লেগেছে শুনেই প্রদীপ এবং আরও তিন জন তখনই দৌড়ে গিয়ে লিফটে করে ১৪ তলায় উঠে যান। অন্য দিকে আগুন লেগেছে দেখে সে সময় আবাসনের বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৪ তলায় উঠে লিফটের দরজা খুলতেই আগুনের হল্কা এবং গরম বাতাস তাঁদের শ্বাসরোধ করে দেয়। লিফট নীচে নামাতে চেষ্টা করলেও ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ করে দেওয়ায় লিফট চলেনি। তিন জনেই সেখানে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গিয়েছেন।

সোমবার দুপুরে মুম্বই থেকে বিমানে শিলিগুড়ির বাড়িতে আনা হয় তাঁর নিথর দেহ। খবর শুনে পড়শিরাও শোকাচ্ছন্ন। অমরবাবু-পূর্ণিমাদেবীদের একই সন্তান প্রদীপ। শোকে এখনও কাঁদতে কাঁদতে বেঁহুশ হয়ে পড়ছেন পূণির্মাদেবী। বছর চারেক আগে খাদ্যনালীতে জটিল সংক্রমণ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে পূণির্মাদেবী। তিনি বলছিলেন, ‘‘ছেলেই তখন মুম্বই থেকে এসে দুই বছর বাড়িতে ছিল আমাকে দেখভালের জন্য। এইমসে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো, আমাকে স্নান করানো, পোশাক পরানো, খাওয়ানো সবই ও করত। সেবা যত্ন করে আমাকে সুস্থ করে তুলেছিল। এখন ও নেই। কী নিয়ে বাঁচব।’’

বাঘা যতীন কলোনিতে প্রদীপদের চার তলা বাড়ি। অমরবাবুই বানিয়েছেন। কিন্তু প্রদীপের ইচ্ছে ছিল তিন তলার ফ্ল্যাটটি নিজেই রোজগারের টাকায় সাজাবে। সেই কারণে ওই তলার কাজ অসম্পূর্ণ। এ বার ফিরলে মিস্ত্রিদের কাজে লাগাবে বলেছিল। তা আর হল না। আফশোস করছিলেন পরিবারের লোকেরা। এলাকার কাউন্সিলর স্নিগ্ধা হাজরা, পাড়ার বাসিন্দা স্বপন ভৌমিক, উমা চন্দ, শতাব্দী দাসরাও শোকাহত। স্বপনবাবু রেলের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। তিনি বলেন, ‘‘পাড়ায় ওর মতো ছেলে কমই রয়েছে। ওঁর মায়ের শরীর খারাপ হলে তো এখানে থেকেই সেবা যত্ন করেছে। দিল্লিতে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেত। এ ভাবে ও চলে গেল, ভাবতেই পারছি না।’’ কাউন্সিলর স্নিগ্ধা দেবী বলেন, ‘‘অনেক দিন থেকে ওদের পরিবারকে চিনি। পাড়ায় জলের কল লাগানো হলে ও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করিয়েছে। ওর মারা যাওয়ার খবর শুনে চমকে উঠেছিলাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন