রতন বর্মন।
কারও বাবা-মা কেউই নেই। দাদার সংসারে অনেক অসুবিধার মুখোমুখি হয়েই চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশোনা। আবার পেশায় কল সারাইয়ের মিস্ত্রির যমজ দুই ছেলে প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে হাসি ফুটিয়েছে বাবা-মায়ের মুখে। আর একজনের বাবা মানসিক রোগী। তাঁকে সামলাতে হিমশিম গোটা পরিবার। আয়ও সামান্যই। একেবারেই প্রতিকুল সেই পরিবেশে পড়াশোনা চালিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করাটাই কঠিন ছিল। হাজার প্রতিবন্ধকতা সামলে ভাল ফল করে তারাই এখন নজির গড়ল।
শিলিগুড়ির নীলনলিনী বিদ্যামন্দিরের রতন বর্মনের বাবা মারা গিয়েছেন অনেকদিন আগেই। মাও চলে গিয়েছেন অন্যত্র। শিলিগুড়ি লাগোয়া বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের মধ্যে বড় ফাঁপড়িতে দাদার এক চিলতে ঘর। হাজার পারিবারিক অশান্তি সহ্য করে সেখানেই কোনওমতে মাথা গুঁজে থাকা। পরীক্ষার আগে পারিবারিক ঝামেলায় প্রায় তিন মাস স্কুলমুখো হতে পারেনি রতন। উদ্বিগ্ন ছিলেন শিক্ষকেরাও। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘‘আমাদের আক্ষেপ আমরা আরও একটু যত্ন নিতে পারলাম না। তা হলে হয়তো মেধা তালিকায় স্থান পেতেও পারত।’’ রতনের প্রাপ্ত নম্বর ৬২১। গৃহশিক্ষক তো দূরের কথা ঠিকমতো পড়ার সুযোগ পায়নি সে।
শিলিগুড়ি বরদাকান্ত বিদ্যাপীঠের সুদীপ ও বিশ্বজিৎ সিংহ যমজ দুই ভাই। সুদীপের প্রাপ্ত নম্বর ৫৮৩, বিশ্বজিতের ৫৫৫। বাবা পেশায় কল মিস্ত্রী। কখনও সাইকেলের কাজও করেন। মা পরিচারিকার কাজ করেন। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনো অবস্থা। তবু স্কুলের শিক্ষকদের উৎসাহে আর নিজেদের অদম্য জেদে দুই ভাই স্কুলের মান রাখতে পেরেছে, বললেন শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষক তমাল চন্দ বলেন, ‘‘বহুদিন থেকেই ওদের দেখছি। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। স্কুল থেকে সমস্ত রকম সাহায্য করা হবে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার জন্য।’’ এ দিন খবর পেয়ে তাদের অর্থ সাহায্য করেন জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি মদন ভট্টাচার্য।
রবীন্দ্রনগর গার্লস হাইস্কুলের নিকিতা ব্রহ্মের প্রাপ্ত নম্বর ৪২৬। বাবা মানসিক রোগী। কোনও রোজগার নেই। মায়ের সময় কাটে বাবার দেখভাল করেই। দাদা কাপড়ের দোকনে কাজ করে কয়েক হাজার টাকা বেতন পান। কাকার নৈশপ্রহরীর কাজের সামান্য বেতন। এই মিলিয়ে পাঁচজনের সংসার খরচ, বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় হয়। এরপরেও স্কুলের পড়াশোনা তাদের মতো পরিবারের পক্ষে কষ্টসাধ্য। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দূর্বা ব্রহ্ম চান, কোনও সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাদের পড়ার খরচ দেন তা হলে সমস্যা কিছুটা মেটে।
শিলিগুড়ি নেতাজি বয়েজ হাইস্কুলের ছাত্র আকাশ মণ্ডলের বাড়ি পূর্ব শান্তিনগরে। বাবা সত্যরঞ্জন মণ্ডল সামান্য মুদিখানার দোকান চালান। কোনও গৃহশিক্ষক দিতে পারেননি। পাড়ার একটি ছেলের কাছেই যতটা পেরেছে সাহায্য নিয়েছে, আর স্কুলের শিক্ষকদের কাছে আটকে গেলে দেখে নেওয়া। এতেই তার প্রাপ্ত নম্বর ৫৫১। বাবার আক্ষেপ, ‘‘আর একটু মনোযোগ দিতে পারলে ছেলে ৬০০ পেতই।’’ দৃষ্টিহীন পরীক্ষার্থী পূজা শাহের নম্বর ৩৩২। নম্বর হিসেবে খুব বেশি নয়। কিন্তু দারিদ্রের সঙ্গেই প্রতিবন্ধকতা শরীরেও। পরীক্ষা দিয়েছে রামকৃষ্ণ সারদামণি বিদ্যাপীঠ থেকে। বাড়ি ধূপগুড়ি। বাবা পেশায় কৃষক। শিলিগুড়িতে প্রেরণা হোমে থেকে সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গেই পড়াশোনা করেছে পূজা। রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে উচ্ছ্বসিত ওই ছাত্রী। রেজাল্ট নিয়েই এ দিন রওনা হয় ধূপগুড়িতে।
—নিজস্ব চিত্র।