গঙ্গাই পাচ্ছে ভাঙনের জেলা

ধরে রাখতে হবে পাড়ের আলগা মাটি

মালদহের বৈষ্ণবনগরের শোভাপুর, পারদেওয়ানাপুর, বীরনগর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের সরকারটোলা, মানিকচক প্রভৃতি জায়গায় আবার নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৬ ০১:১৮
Share:

পাড় ভেঙে ভেসেছে ঘর-জমি। সম্বল কি শুধুই হতাশা? মালদহের বীরনগরে মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

মালদহের বৈষ্ণবনগরের শোভাপুর, পারদেওয়ানাপুর, বীরনগর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের সরকারটোলা, মানিকচক প্রভৃতি জায়গায় আবার নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু কেন? এক, অনেকের আশঙ্কা বাঁধই মালদহের ভাঙনের বড় সমস্যা। বাঁধ দেওয়ার পর থেকেই গঙ্গার গতিশীল ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এই সময় গঙ্গা তার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য ফারাক্কা ব্যারাজ ভাঙতে চায়। কিন্তু কংক্রিটের ফরাক্কা ব্যারাজ ভাঙতে পারে না। কঠিন শিলায় তৈরি রাজমহল পাহাড়কেও সে ভাঙতে পারে না। কাজেই নরম পলির স্তর দিয়ে নির্মিত মালদহ জেলাকে ভেঙে বিকল্প যাত্রাপথ তৈরির চেষ্টা করে। আর এই কারণেই বার বার ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে মালদহে।

দুই, গঙ্গা নদীর পাড়ের চরিত্র একটু ভিন্ন রকম। একদম ওপরের দিকে রয়েছে নরম পলিস্তর। আর ঠিক নীচে রয়েছে চওড়া বালির স্তর। আবার বালির স্তরের নীচেই রয়েছে স্বল্প প্রস্থের পলির স্তর। বর্ষা বা বন্যার সময় নদী যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, তখন নদীর জল বালির স্তরের মধ্যে প্রবেশ করে। আবার বন্যার জল নেমে যাবার সময় বালির স্তরের মধ্য থেকে প্রচুর বালি বের করে নিয়ে সে চলে যায়। বস্তুতই বালির স্তর আলগা হয়ে যায় এবং নদী ভাঙন সৃষ্টি করে মালদহতে।

Advertisement

তিন, রবার্ট ওয়াসিম নামক একজন নদী বিজ্ঞানী হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে, গঙ্গা প্রতি বছর ৮০ কোটি টন পলি বয়ে আনে গাঙ্গেয় বদ্বীপে। এর মধ্যে ৩০ কোটি টন পলি পদ্মা হয়ে বাংলাদেশে চলে যায়। বাকি ৫০ কোটি টন পলি প্রতি বছর ফরাক্কার উজানে জমা হচ্ছে। এই পলি বেরিয়ে যাওয়ার কোনও পথ নেই। কারণ ফরাক্কা ব্যারাজ যখন নির্মাণ হয়েছিল, তখন ব্যারাজের স্লুইস গেটগুলোর নীচে কংক্রিটের ভিতটি ৮ ফুট উঁচুতে রাখা হয়েছিল। ফলে গঙ্গার গভীরতার খাতটি উঁচু হয়ে যায়। বিগত তিন দশকে গঙ্গার খাত প্রায় ৪০ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে। তাই একটু বৃষ্টি হলেই গঙ্গা কানায় কানায় ভরে যায় এবং নদী ভাঙন সৃষ্টি করে।

চার, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে নদী বারবার তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এই পদ্ধতিটিকে নদী বিজ্ঞানের ভাষায় ‘রিভার অসিলেশন’ বলে। ফরাক্কা ব্যারাজের পর থেকে গঙ্গা মালদহের বাঁ-দিক বরাবর তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল পঞ্চানন্দপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভাঙন। ২০০৬ সালে গঙ্গার ‘মিড চ্যানেলটি’ সক্রিয় হবার জন্য গঙ্গার মূল স্রোতটি প্রবাহিত হত ‘মিড চ্যানেলে’র পথ ধরে। ফলে পঞ্চানন্দপুরের ভাঙনটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ফরাক্কার নিকটবর্তী অংশের প্রান্তীয় স্রোতধারাটি সক্রিয় হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। ফলে বীরনগর অংশে ভাঙন শুরু হয়। স্থানীয় মানুষেরা এই ভাঙনকে বলছে ‘নীচ বসা’ ভাঙন। অর্থাৎ নদী পাড়ের তলদেশ কেটে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বার প্রশ্ন হল, এই ভাঙন থেকে বাঁচার উপায় কী? প্রথমেই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে রাখা ভাল, ভাঙন সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে ভাঙনের হারকে কমানো সম্ভব। কী ভাবে?

এক, নদীর ভাঙন প্রবণ অঞ্চলে ভেটিভার ঘাস লাগানো। এই ঘাসের মূল অনেক গভীর পর্যন্ত মাটিকে ধরে রাখে। ভেটিভার ঘাসের বিকল্প হিসেবে কাশ ঘাসও লাগানো যেতে পারে। কারণ কাশের মূলও প্রায় ভেটিভারের মতো মাটির নীচে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং আলগা মাটিকে ধরে রাখতে সক্ষম।

দুই, বোল্ডার দিয়ে নদীর পাড় বাঁধানোর জন্য শুখা মরসুমে নদীর সর্বনিম্ন জলস্তর থেকে কাজ শুরু করতে হবে। বর্ষাকালে পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু করে কোনও লাভ হয় না।

তিন, ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘ফ্লাই অ্যাশ’-কে ব্যবহার করে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে তাতে জলদূষণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চার, নদীকে ড্রেজিং করে পলি তোলার কাজটি করতে হবে এবং নদী খাতের গভীরতা বাড়াতে হবে। যাতে বৃষ্টির অতিরিক্ত জলকে নদী ধরে রাখতে পারে।

পাঁচ, ফুলাহার ও মরাকোশি নদী বর্ষার সময় প্রচুর জল বয়ে এনে ধাক্কা দেয় ভূতানি ও মানিকচকের কাছে। ভাঙন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফুলাহার ও মারকোশি নদীর জলকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর জন্য বিহার সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলোচনায় বসা প্রয়োজন।

লেখক নদী বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন