নদীগর্ভে: গঙ্গার ভাঙনে এই ভাবে ধীরে ধীরে নদীতে মিশে যাচ্ছে বাড়ি। মালদহের বৈষ্ণবনগরে নদীপাড়ের ছবি। নিজস্ব চিত্র
কৈশোরে মন টানত গঙ্গা। প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথ ছিল তখন। সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে কখনও হাঁফও ধরত। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ফের ছুটত সাইকেল। তার পরে যুবক হতে হতে তিনি দেখলেন, গঙ্গা চলে এসেছে বাড়ি থেকে মাত্র তিনশো মিটার দূরে! এখন ষাটের গণ্ডি টপকেছেন। ভোটে জিতে চার বছর আগে বিধানসভাতেও পা রেখেছেন। কিন্তু ছোটবেলার সেই বাড়িটা আর নেই স্বাধীন সরকারের। গঙ্গা গিলে নিয়েছে ভিটেমাটি।
গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে এখনও মাঝে মাঝে ঠাকুরদার স্মৃতি মেশা সেই বাড়ি খোঁজেন বৈষ্ণবনগরের বিজেপি বিধায়ক। বলেন, ‘‘ছোটবেলায় গঙ্গায় যেতে সাইকেল লাগত, ভাবতে পারেন! ভিটে হারিয়ে এখন বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রয়েছি।’’ স্বাধীনবাবুর বৃদ্ধা মা প্রভাবতীদেবী বলেন, ‘‘নদী যে কখনও অভিশাপ হয়ে উঠবে, তা ভাবতেও পারিনি!’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’কে মনে পড়িয়ে দেয় মালদহের এই ভয়ঙ্করী গঙ্গা। নিমেষের মধ্যে রাইচরণের খোকাবাবুকে গিলে নিয়েছিল নদী। বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’। কাহিনি শেষে সেখানে ভাঙনের মাটি নিয়ে গঙ্গায় মিশে যায় সেই মেয়ে। নবকুমারের বাড়িয়ে দেওয়া হাত শূন্যে ঘুরে ফিরে আসে। বাস্তবের স্বাধীন সরকারের হাতও শূন্য করে সব নিয়ে গিয়েছে গঙ্গা।
গঙ্গাপাড়ের বৃত্তান্ত
• ঘরবাড়ি ভেঙেছে: প্রায় সাড়ে চার লক্ষ
• চাষের জমি তলিয়েছে: কয়েক হাজার হেক্টর
• স্কুলবাড়ি: সাতটি প্রাথমিক ও ১৪টি হাইস্কুল
• আমবাগান: প্রায় হাজার খানেক হেক্টর
যেমন নিয়েছে অরুণ সরকারেরও। স্বাধীনের বাড়ি ছিল বৈষ্ণবনগরের বিননগর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারটোলায়। আর অরুণের মানিকচকের ডোমহাট বাঁধ এলাকায়। অরুণ বলেন, ‘‘চাষের জমি ছিল। বসত ভিটেও ছিল। সবই এখন অতীত। সব গঙ্গা গর্ভে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে বাঁধে বাস করছি।’’ নতুন করে তিনবার ঘর বেঁধেছিলেন কালিয়াচকের গোলাপমণ্ডল পাড়ার সত্তরোর্ধ্ব দিলবর হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘তিনবারই ঘরবাড়ি সব নদী গিলে নিয়েছে। তবুও নদী পাড়েই আবার ঘর বাঁধতে হয়েছে।’’
যে বারে স্বাধীনের বাড়ি চলে যায়, সেই ২০১৬ সালে গঙ্গায় ভিটে হারিয়েছিলেন আরও শতাধিক মানুষ। সেখানেই থামেনি নদী। ফি বছর বৈষ্ণবনগরের সরকারটোলা, পারদেওয়ানপুর, অনুপনগরের মতো বহু গ্রামের মানুষ ভিটেহারা হচ্ছেন। নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে একরের পর একর চাষের জমি।
কেন বিধ্বংসী হয়ে উঠল গঙ্গা? নদী বিশেষজ্ঞদের কথায়, মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীর উপরে ১৯৭১ সালে তৈরি হয় ফরাক্কা ব্যারেজ। ১০৯টি স্তম্ভ রয়েছে ব্যারেজে। তলায় রয়েছে কংক্রিটের বাঁধ। সেই বাঁধেই থিতিয়ে যাচ্ছে পলি। চর জমছে গঙ্গার মাঝে। ফলে দুই কূলে ধাক্কা খাচ্ছে গঙ্গা। আর মাটি কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে নদীপাড়ের, জানিয়েছেন ভাঙন বিশেষজ্ঞ মানব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘সাতের দশকের পর থেকেই মালদহে ব্যাপক হারে গঙ্গার ভাঙন শুরু হয়েছে। হাজার হাজার বাড়ি নদীতে তলিয়েছে। বিঘার পর বিঘা জমিও নদীগর্ভে।’’ কী ভাবে ঠেকানো যাবে এই ভাঙন? মানববাবুর কথায়, ‘‘গঙ্গার নাব্যতা বাড়াতে হবে। তবেই ঠেকানো যাবে বিধ্বংসী গঙ্গাকে।’’
নদী বিশেষজ্ঞদের কথায়, মালদহের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি। তাই এই জেলায় মাটি ভাঙছে দ্রুত হারে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্যাপকহারে ভাঙন হয়েছে। মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে কালিয়াচক-২ ব্লকের ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েত। কয়েক হাজার হেক্টর চাষের জমি, প্রায় সাড়ে চার লক্ষ বাড়ি, বহু প্রাথমিক স্কুল, হাইস্কুলও বিলীন গঙ্গায়।
বছর দুয়েক আগে ফের নদীপাড়েই ঘর বেঁধেছেন স্বাধীন। ঘর বেঁধেছেন দিলু রহমান, আজাদ শেখ, পাণ্ডব মণ্ডলেরাও। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদের গোটা জীবনের সাক্ষীই তো গঙ্গা। তাই তার উপরে অভিমান করে দূরে থাকব কী ভাবে!’’