কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নিহত পার্থ রায়ের মা। তাঁকে ঘিরে পরিজন ও পড়শিরা।
পিকনিক বা পানভোজনের আসরের গণ্ডগোল খুনোখুনিতে গড়ানোয় শিউরে উঠছেন অনেকেই। এখন পিকনিকের মরসুম। বিভিন্ন এলাকায় বাসিন্দাদের তরফেই দাবি উঠেছে, সব কটি পিকনিক স্পটে নজরদারির জন্য পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ কমিটি গড়া হোক।
রবিবার আশিঘর লাগোয়া বনাঞ্চলে পিকনিকের সময়ে নদী থেকে জল নেওয়ার সময়ে যে গোলমাল হয়েছিল, তা লোকজনদের হস্তক্ষেপে মিটেও গিয়েছিল। পরে তার জেরে সন্ধ্যার মুখে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে যে ভাবে এক যুবককে পিটিয়ে মারা হয়েছে ও ২ জনকে জখম করা হয়েছে সেই দৃশ্যের কথা ভাবলেই আঁতকে উঠছেন বহু বাসিন্দা। কারণ, পিকনিকে গানবাজনা, পানভোজন অনেক সময়েই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তাতেই গোলমালের আশঙ্কা থাকে। কোনও কমিটি থাকলে তাঁরা মধ্যস্থতা করে পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে পরিস্থিতি গোড়াতেই সামাল দিতে পারবেন বলে ভুক্তভোগী এলাকাবাসীরা মনে করেন। বাসিন্দাদের ওই আর্জির কথা পৌঁছেছে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকারের কাছেও। জেলাশাসক বলেন, ‘‘পিকনিকের মরসুমে প্রশাসন সতর্কই থাকে। জলপাইগুড়ি ও লাগোয়া শিলিগুড়ির সংযোজিত এলাকায় পিকনিক-স্পটে কমিটি গঠন করা হবে।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, সামগ্রিক পরিস্থিতি আঁচ করেই রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি এন রমেশবাবু সব ক’টি জেলার এসপি-কে পিকনিক-স্পট-এ ছুটির দিনগুলিতে বাড়তি নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘটনাচক্রে, ওই এলাকার বিধায়ক উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের কারণে বর্তমানে কলকাতায় রয়েছেন। গৌতমবাবুও ঘটনাটি শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ঠিক কী হয়েছে খোঁজ নেব। সরকারি তরফে যা করণীয়, তা করা হবে।’’
গত রবিবার দুপুরে ফারাবাড়িতে সাহু নদীর পাশে ‘বৈকুন্ঠপুর থারোঘাটি’তে ১০টি দলে অন্তত শ’তিনেক বাসিন্দা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পিকনিক করছিলেন। তাঁদের অনেকেই কয়েকজন যুবকদের বচসা-হাতাহাতির সাক্ষী। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা অনেকেরই দাবি, প্রশাসনের একটু সর্তক নজর থাকলেই গোলমালটা হত না। তাঁরা জানান, শীতের মরসুমে প্রতিদিনই নদীর ধারে অথবা জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় পিকনিকের আসর বসছে। বাসিন্দাদের দাবি, অযথা দেরি না করে প্রশাসন দ্রুত সক্রিয় হোক।
কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় ব্লক প্রশাসনও। ইতিমধ্যে ফারাবাড়ি লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কমিটি নিয়ে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ব্লকের তরফে। রাজগঞ্জের বিডিও এনসি শেরপা বলেন, ‘‘চলতি সপ্তাহেই ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। পুলিশ প্রশাসনকেও চিঠি দিচ্ছি।’’
‘পিকনিক-স্পট’-এ সর্বত্র যে বাড়তি নজর রাখা জরুরি, তা মানছেন পুলিশের উত্তরবঙ্গের প্রথম সারির অফিসারদের অনেকেই। কারণ, তিস্তা-মহানন্দা থেকে কুলিক নদীর ধারে সর্বত্রই পিকনিককে কেন্দ্র করে গোলমাল, সংঘর্ষ ঘটে।
নভেম্বর মাসেই ধুন্ধুমার বেঁধে গিয়েছিল জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তাপাড়ে। ছুটির দুপুরে তিস্তার চরে পিকনিক আসর ছিল জমজমাট। হঠাৎই পিকনিকের দলে থাকা এক যুবক এলাকারই এক যুবতীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে। যুবতী প্রত্যাখ্যান করলে অশালীন ইঙ্গিতও করা হয় বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। ওই যুবক মদ্যপ ছিল বলেও যুবতীর দাবি। এর পরেই শুরু হয় তুমুল গোলমাল। স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন বাঁশ নিয়ে তাড়া করে পিকনিকের দলে থাকা যুবকদের। পাল্টা তেড়েও যায় কয়েকজন যুবক। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে গালিগালাজ, মারপিট। মুহূর্তে পিকনিকের জমাট আসর বদলে যায় আতঙ্কে। ওই দলটি তো বটেই অন্য পিকনিকের দলে আসা বাসিন্দারাও ভয়ে রান্না-খেলা বন্ধ করে তিস্তা চর ছেড়ে তড়িঘড়ি চলে যায়।
গোলমালের জেরে শহর লাগোয়া কোনপাকড়ি এলাকার একটি পিকনিক স্পটে বহিরাগতদের ঢোকাই বন্ধ করে দিয়েছেন বাসিন্দাদের একাংশ। রায়গঞ্জের কুলিক পক্ষীনিবাসের অসংরক্ষিত এলাকায় একটি পিকনিকের দলকে ডিজে বক্সের শব্দ কমাতে বলায় এক ব্যক্তি উনুন থেকে জলন্ত কাঠ নিয়ে বাসিন্দাদের দিকে তেড়ে যান। আবার, বেলাকোবার বোদাগঞ্জে পিকনিকের দলের থেকে তোলা আদায়ের অভিযোগও ওঠে।
এই অবস্থায়, সেবক, কুলিক, মালদহের আদিনা, কোচবিহারের রসিকবিল, আলিপুরদুয়ারের জয়ন্তী, রাজাভাতখাওয়া, জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চল ও মূর্তি নদীর ধারের বিস্তীর্ণ এলাকায় পুলিশকে টহল বাড়ানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির একাধিক অফিসার জানান, ১ জানুয়ারি সেবক ও লাটাগুড়ি এলাকায় বাড়তি টহল দেওয়ায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের এক কর্তা জানান, পিকনিক-স্পট লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে কোনও কমিটি থাকলে গোলমালের প্রবণতা আরও কমে যাবে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৭ জানুয়ারি শিলিগুড়ি ফিরবেন। এর পরে প্রথম সরকারি বৈঠকেই তিনি বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপের চেষ্টা করবেন বলে মন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন।