শিশু পাচার কাণ্ডে বিজেপি নেত্রী জুহি চৌধুরী শাস্তি চেয়ে বিজেপি অফিসের সামনে বিক্ষোভ তৃণমূলের। জলপাইগুড়িতে। — সন্দীপ পাল
সময়ের কোন বালাই ছিল না৷ স্কুল শুরুর সময় এগারোটা হলেও, কোনও দিন তার দেখা মিলত সাড়ে এগারোটায়, কোনও দিন বারোটায়, কোনও দিন আবার তারও পরে৷ ছুটি নেওয়ার ক্ষেত্রেও কাউকে তোয়াক্কা করার কোনও ব্যাপার ছিল না তাঁর৷ অভিযোগ, হোমের মতোই স্কুলেও এ ভাবে নিজের মর্জিমাফিক চলতেন নর্থ বেঙ্গল পিপলস ডেভলপমেন্ট সেন্ট্রারের কর্ণধার চন্দনা চক্রবর্তী৷
শিশু পাচারের অভিযোগে গত শনিবার সিআইডি-র হাতে গ্রেফতার হন চন্দনা এবং তাঁর সঙ্গী সোনালি মণ্ডল৷ সব সময় মুখে মিষ্টি ব্যবহার করে যাওয়া একজন শিক্ষিকা যে এমন কাজে যুক্ত থাকতে পারেন, তা বিশ্বাসই করতে পারছে না ময়নাগুড়ির আনন্দনগর৷ ওই এলাকাতেই অবস্থিত আনন্দনগর নিম্ন বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চন্দনা৷ তবে এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, নিজের কুকর্ম ঢাকতেই সবার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন চন্দনা৷
১৯৫৯ সালে আনন্দনগর নিম্ন বুনিয়াদী স্কুলটি চালু হয়৷ ১৯৯৭ সালে সেখানে শিক্ষিকা হিসেবে কাজে যোগ দেন চন্দনা৷ স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে প্রধান শিক্ষক স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ চালাতেন চন্দনা৷ ২০১৪ সালে পাকাপাকি ভাবে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হন তিনি৷
স্কুলে যাওয়ার সময়ের ঠিক নেই। কিন্তু যেতেন যখন, তখন যেতেন নিজের সাদা গাড়ি চেপে। চন্দনার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, দেরিতে আসার কারণ জানতে চাইলেই উনি বলতেন, হোমের কাজে দেরি হয়ে গিয়েছে৷ তবে এই দেরিতে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে কিন্তু কম ঝক্কিও পোহাতে হয়নি৷ একাধিকবার স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে৷ এমনকী, স্কুলের মুখে থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানাচ্ছেন বাসিন্দারা৷ যদিও তাতে বিশেষ হেলদোল ছিল না চন্দনার। শনিবার গ্রেফতারের দিন পর্যন্তও তিনি একই কাজ করে গিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন তাঁরা৷
সহকর্মী ও পড়শিরা জানাচ্ছেন, এ সব সামলাতে চন্দনার মূল অস্ত্রই ছিল মিষ্টি ব্যবহার৷ ছাত্র-ছাত্রী বা তার সহকর্মীদের সঙ্গে তো বটেই, এমনকী স্কুলের আশপাশে থাকা বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গেও সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। কেউ সমস্যায় পড়েছে শুনলেও এগিয়ে যেতেন। দিন কয়েক আগে স্কুলের মধ্যে এক ছাত্র পায়ে আঘাত পেয়েছে শুনে তাকে কোলে করে বাড়ি পৌছে দিয়ে এলেন।
শনিবার চন্দনা গ্রেফতার হওয়ার পরে সকলেই বলছেন, এ সবই তাঁর কুকর্ম ঢাকার অছিলা। স্থানীয় বাসিন্দা রুমা মণ্ডল বলছেন, সারাদিন ধরে শিশুদের যিনি শিক্ষা দেন, তেমন এক জন শিক্ষিকা শিশু পাচার করেন কী করে, ভাবতেই পারছি না৷ আরেক পড়শি ঋণা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ওকে দেখে বুঝতেই পারিনি, ওর ভেতরে কী রয়েছে! চন্দনার দুই সহকর্মী মলয় কাঠাম বা কৃষ্ণা ভট্টাচার্যরা বলেন, ‘‘আমাদের ও বলেছিল স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি হোম চালানোর মধ্য দিয়ে ও সমাজসেবা মূলক কাজ করে৷ আমরাও সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম।’’
কীর্তি আরও আছে চন্দনার। সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, বছর দুয়েক আগে চন্দনা ওর হোমের দুই শিশুকেও এই স্কুলে ভর্তি করান। দুই-তিন মাস অন্তর তাদের এনে দিন দুই-তিন ক্লাস করাতেন। আর তারা আসত পরীক্ষার সময়ে। অন্য শিক্ষকদের কথায়, চন্দনাকে তাঁরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এত অনিয়মিত ভাবে দু’টি শিশু যে স্কুলে আসে, সেটা তো কোনও নিয়মে পড়ে না৷ জবাবে চন্দনা তাঁদের জানান, তাঁর কাছে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ রয়েছে৷
যদিও ময়নাগুড়ির অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক সেরিং ডি ভুটিয়া বলেন, ‘‘এমন কোনও নির্দেশ বা অনুমতি আমরা কখনও দিইনি৷ স্কুলে ঠিক সময় না আসা নিয়েও চন্দনাকে বহু বার সতর্ক করা হয়েছিল৷’’