জলকেলি শেষ, বিদায় নদী, তিস্তা পাড়ের হস্তী বৃত্তান্ত

বাঘারু নেই, নদীও নয় ডায়না। তবু, বৃস্পতিবার বৃষ্টি ভেজা ভোরে, বাঁচার লড়াইটা বিকেলতক ভেসে থাকল তিস্তার বুকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মালবাজার শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৬ ০৮:৩৪
Share:

দিনের শুরু থেকে তিস্তায় গা ভিজিয়েছিল সে। মরা বিকেলে দেখা গেল ধীরে ধীরে উঠে আসছে পাড়ে। তার পর যাত্রা বনের পথে। গজগমনের তিনটি ছবিই তুলেছেন দীপঙ্কর ঘটক।

বৃত্তান্তটা তিস্তাপাড়েরই বটে!

Advertisement

বাঘারু নেই, নদীও নয় ডায়না। তবু, বৃস্পতিবার বৃষ্টি ভেজা ভোরে, বাঁচার লড়াইটা বিকেলতক ভেসে থাকল তিস্তার বুকে।

তার পর, এক সময়ে ধীর লয়ে মরণ ঠেলে, তিস্তার ব্যারাজ ঘেঁষে সে উঠে পড়ল পাড়ে। তার পর, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই হারিয়ে গেল বৈকুণ্ঠপুরের গাছগাছালির দিকে।

Advertisement

গল্পটা একটা মাকনা হাতির।

বৃহস্পতিবার সকালে সরস্বতীপুরের দিক থেকে দলের পিছনে নিশ্চুপে হেঁটে আসার সময়ে তিস্তার হাঁটু জলে হঠাৎই থমকে গিয়েছিল হাতিটি। কেন? কেউ জানে না। সোজা-সাপ্টা উত্তর ছিল না কারও কাছে। বাল-বাচ্চা হস্তীকুল দিব্যি পেরিয়ে গেলেও, অমন সুস্থ সবল মাকনা কেন নদীর বুকে থমকে গেল? প্রশ্নটা নিয়ে সকাল থেকে নদীর পাড়ে ভিড় করেন গ্রামবাসীরা। উত্তর ছিল না বনকর্তাদের মুখেও। অথচ মেঘলা আকাশ ঝলসে উঠছে। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল বলে। ভরা আষাঢ়ের জলে টইটম্বুর নদী সাঁতরাতে পারবে তো সে, ঘোর স্রোতে ভেসে যাবে না তো?

কপালে ভাঁজ ফেলে বনকর্তারাও ভাবছিলেন সে কথা। কিন্তু উপায় কী, হাতি যে নড়ে না। খবরটা কানে গিয়েছিল সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। হাতি কি আটকে গিয়েছে নদীর চরায়? মন্ত্রীর পরামর্শ মেনে, ব্যারাজের নির্বাহী বাস্তুকার হাতি-বাঁচাতে আরও তিনটি লকগেট খুলে দিলেন। ছাড়া হল অতিরিক্ত ৮০০ কিউসেক জল। ঘনঘন ফোন করছেন বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন— ‘‘হাতি উঠল?’’ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতি বারই মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) সুমিতা ঘটক ভরসা জোগাচ্ছেন, ‘‘চেষ্টা চলছে স্যার। চিন্তা করবেন না।’’

বনকর্মীদের দু-এক জন পরামর্শ দিলের পটকা ফাটানোর। ভয় পেয়ে সে যদি নদীর কোল থেকে উঠে আসে, কিন্তু সে সবে কাজ দিল না তেমন। অতিকায় মাকনা হাতি নদীর স্রোত বুকে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জলে।

দুপুর নাগাদ নদীতে জল বুঝি কমল। হাতিও যেন নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। নদী না পেরিয়ে সে চলল কোথায়, তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চর বরাবর সে এ বার পা বাড়াল ব্যারাজের দিকে। সেতুর ওপর তখন হাজার উৎসাহীর ভিড়। সেখান থেকে এ বার শুরু হল ঘনঘন পটকা ফাটানো। চালু করে দেওয়া হল গাড়ির হুটারও। কিন্তু হাতি তার মন্দাক্রান্তা চালে হেঁটেই চলেছে হাওয়ামহলের দিকে। এ ভাবে চললে লকগেটের মাঝে ঢুকে গেলে তো সর্বনাশ, প্রমাদ গোনেন বনকর্মীরা। ফের শুরু হল ক্রমাগতচকোলেট বোমা ফাটানো। সঙ্গে উৎসাহী জনতার সোল্লাশ। লকগেটের খানিক দূরে হল্লা আর পটকার শব্দে তার বুঝি সম্বিৎ ফিরল। এ দিকে, অন্ধকার নেমে এসেছে নদীতে। আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টিও নেমেছে। আঁধার সাঁঝে হাতি এ বার কোনওক্রমে উঠল পাড়ে। সেখানে তখন হাজারো মানুষের ভিড়। দিনভর বাঁচার লড়াইয়ে জিতে সে যদি এ বার খেপে যায়?

দলছুট মাকনা অবশ্য সে সবে সাড়া দেয় না। বরং ধীরস্থির, দুলকি চালে নিশ্চিৎ মৃত্যুকে ঠেলে সন্ধ্যার অন্ধকারেই হারিয়ে য়ায় সে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন