লাইন কি বদলাচ্ছে

পা বাড়ালেই নেপাল। কাঁকরভিটা ধূলাবাড়ি-বিরতা মোড়ে সে এক বিশাল বাজার। আলোয় ঝলমল ক্যাসিনো। বৈধ-অবৈধ হরেক ব্যবসার হাতছানি। পণ্য মেচি পেরিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছলেই নগদের আমদানি।

Advertisement

কিশোর সাহা

নকশালবাড়ি শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৭ ০২:৪৯
Share:

১৯৬৭: নকশালবাড়িতে এক সভায় চারু মজুমদার (ডান দিকে)। ফাইল চিত্র

পা বাড়ালেই নেপাল। কাঁকরভিটা ধূলাবাড়ি-বিরতা মোড়ে সে এক বিশাল বাজার। আলোয় ঝলমল ক্যাসিনো। বৈধ-অবৈধ হরেক ব্যবসার হাতছানি। পণ্য মেচি পেরিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছলেই নগদের আমদানি। চা বাগানের জমি দখল করে রমরমা কারবার। একের পর এক ঝাঁ চকচকে পার্টি অফিস। নকশালবাড়ির কোন ব্যবসায়ী নগদ ও জমিজমা, প্রাসাদোপম ভবনের মালিকানায় শিলিগুড়ির তাবড় ধনীকেও টেক্কা দিতে পারেন, তা নিয়েও গুলতানির অন্ত নেই। সৌজন্য ‘নকশাল-লাইন’।

Advertisement

শিলিগুড়ি, নকশালবাড়ির ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একাংশই একান্তে এ কথা মানছেন। এবং তাঁরা বলছেন, ‘‘এলাকার তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ নকশালবাড়িতে লাইন বলতে নেপাল থেকে চোরাপথে পণ্য আনার কারবারই বুঝত। কিন্তু, আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে ফের সত্যিকারের ‘নকশাল-লাইন’ কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।’’

তাতেই আশার আলো দেখছেন এখনও নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় মানুষ। যেমন, ১৯৬৭ সালের ২৪ মার্চ নকশালবাড়ির মিছিলে হেঁটেছিলেন খেমু সিংহ। তিনি বললেন, ‘‘মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সারা বছর আন্দোলন না হওয়ায় নকশাল লাইনের মানেটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। এখন সুবর্ণজয়ন্তীতে মিটিং-মিছিল হচ্ছে। নকশালবাড়ি মানেই চোরাচালানের লাইন নয় সেটা অন্তত সামনে আসছে।’’

Advertisement

মে, ১৯৬৭: এই দুই ঘটনাই আগুন ধরিয়েছিল নকশালবাড়িতে। আনন্দবাজারের পাতা থেকে।

একটা সময় অবধি ‘নকশাল-লাইন’ বললেই ভেসে উঠত চারু মজুমদার, জঙ্গল সাঁওতাল, কানু সান্যালদের শক্ত চোয়ালের কঠিন মুখ। কিন্তু গত কয়েক দশকে নকশালবাড়ির চেহারা যে ভাবে বদলেছে, তাতে সে সব প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। যেমন, এসজেডিএ মার্কেটের দুই তরুণ ব্যবসায়ী প্রায় ১২ বছর ধরে বিদেশি পণ্যের দোকান চালাচ্ছেন। দু’জনেই বললেন, ‘‘আমাদের কাছে নকশাল-লাইন মানে নেপাল থেকে জিনিস কিনে মেচি পেরিয়ে শিলিগুড়িতে আনা।’’ শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটের কয়েক জন তরুণও একান্তে আক্ষেপ করেন, ইদানীং সীমান্তে কড়াকড়ি বেড়ে যাওয়ায় মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকছে ‘নকশাল-লাইন’।

সেই নকশালবাড়িই আবার শিরোনামে। কারণ, তা বড় নেতাদের জমজমাট পুরো এলাকা। এবং নকশাল আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তীও। সব মিলিয়ে তাই নকশাল আন্দোলনের পুরনো কাহিনি ঝালিয়ে নিচ্ছেন সবাই।

নকশালবাড়ির মুখটা এখন অনেক চকচকে হয়েছে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে সেই যন্ত্রণা, সমস্যার ছবি। নকশালবাড়ির রামভোলা এলাকার চা শ্রমিক সান্ত্বনা মল্লিক, হলগু নাগাশিয়ারা বলেন, ‘‘চা বাগানের জমি দখল হচ্ছে। মজুরি তেমন বাড়ছে না। নতুন ছেলেমেয়েরা বাগানের চেয়ে ‘লাইনে’ (চোরাচালান) ঝুঁকছে। বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেসের কত বড় নেতারা যাতায়াত করছেন। কাজের কাজ হয় না কেন, বুঝি না।’’

২০১৭: শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কে সিপিআইএমএলের সমাবেশ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নকশালদের প্রথম সারির নেতারাও। সিপিআইএম-এল লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নকশালবাড়িকে ব্যবহার করে বিজেপি ও তৃণমূল রাজনীতি করছে। এরা কেউ নকশালবাড়ির তাৎপর্য-আর্দশকে ছড়াতে চায় না।’’ সিপিআইএম-এল (নিউ ডেমোক্রেসি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চন্দন প্রামাণিক বলেন, ‘‘আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন না, তাঁদের অনেককেই আজ নকশালবাড়িতে দেখা যাচ্ছে।’’

নকশালবাড়ি দেখেছে, রাজু মাহালির দাওয়ায় অমিত শাহের পাত পেড়ে খাওয়া। তার পরে দেখেছে, সেই রাজুর তৃণমূলে যোগ দেওয়া। ভিড়ের চাপে ভেঙে যাওয়া ঘরদোর সারাই হলেও পাকা চাকরি এখনও জোটেনি রাজুর। পদ্মফুল, ঘাসফুল পেরিয়ে আপাতত নকশালবাড়ির রং আবার লালে লাল। সে দিকে তাকিয়ে বিস্মিত রাজু বলেন, ‘‘কোথা থেকে কী যে হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যে থামবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন