উত্তরের কড়চা

কবি পক্ষে জলপাইগুড়ির ‘সৃজনধারা’ (সম্পাদক পার্থপ্রতিম মল্লিক) পত্রিকা গোষ্ঠী আয়োজন করেছিল বিশেষ আলোচনাসভার। সম্পাদক স্বাগত ভাষণে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সূত্রে জানান, শুধু নাচ গানের মধ্যেই রবীন্দ্রস্মরণ নয়, তাঁকে মননে ও স্থান দিতে হবে। তাঁর মতে অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে রবীন্দ্রনাথ এখনও অজানা, অচেনা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বকবি বিশ্ববাসীর কাছে কতটা গ্রহণীয় হয়ে উঠেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০২:১৪
Share:

মননে রবীন্দ্রনাথ

Advertisement

কবি পক্ষে জলপাইগুড়ির ‘সৃজনধারা’ (সম্পাদক পার্থপ্রতিম মল্লিক) পত্রিকা গোষ্ঠী আয়োজন করেছিল বিশেষ আলোচনাসভার। সম্পাদক স্বাগত ভাষণে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সূত্রে জানান, শুধু নাচ গানের মধ্যেই রবীন্দ্রস্মরণ নয়, তাঁকে মননে ও স্থান দিতে হবে। তাঁর মতে অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে রবীন্দ্রনাথ এখনও অজানা, অচেনা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বকবি বিশ্ববাসীর কাছে কতটা গ্রহণীয় হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন ভাষায় রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ কর্মের মধ্যে দিয়ে সমগ্র রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ব্যক্ত হবে। মুখ্য আলোচক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথের নানা দিক আলোচনার পরিসরে তুলে ধরেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে লেখা চিঠিপত্রগুলি থেকে পাওয়া যায় কবির সাংসারিক জীবনের পরিচয়। যা অন্যত্র পাওয়া সম্ভব নয়। শৈশব থেকেই রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি রপ্ত করেছিলেন দু’একটি বিদেশি ভাষাও। পৃথিবীজুড়ে ভ্রমণ করেছেন তারই প্রেক্ষিতে পাই বিদেশযাত্রী রবীন্দ্রনাথকে। নাটক রচনার পাশাপাশি নাট্য প্রয়োজনাও করেছেন, যেমন তাসের দেশ। বক্তার পিতৃদেব বিজনবিহারী ভট্টাচার্য সেই নাটকে অভিনয় করেছেন, জানা গেল সে কথাও। সে নাটকের পোশাক ও মঞ্চসজ্জায় ছিলেন নন্দলাল বসু। কবি শেষজীবনে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং তুলি। যা বিশ্বের কাছে অন্যমাত্রার পরিচয় এনে দিল। সঙ্গীত রচয়িতার সঙ্গে তার গায়ক পরিচয়টি প্রায় দুর্লভ। আলোচনা সূত্রে পাওয়া গেল শিক্ষক সংগঠক জমিদার এবং একই সঙ্গে বিশ্বকবির আদর্শ পিতার ভূমিকার ছবিটি।

Advertisement

মিলন মেলা

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটিকে সামনে রেখে ৮ ও ৯ মে গৌড় মহাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হল রবীন্দ্রজন্মোৎসব এবং প্রাক্তনীদের মিলন মেলা। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পালিত হল রবীন্দ্রবিষয়ক বিশেষ আলোচনার মধ্যে দিয়ে। ক্ষিতীশ মাহাতো আলোচনা সূত্রে বলেন রবীন্দ্রজীবন দর্শনে প্রাধান্য পেয়েছিল ঈশ্বরতত্ত্ব। ‘সোনার তরী’ পর্বে সেই ঈশ্বরের সঙ্গে তার প্রথম দর্শনলাভ। ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে/দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ঈশ্বরকে চেনার সেই শুরু। আলোচকের মতে, পরবর্তী কালে এই জীবনদেবতার সঙ্গেই তার জীবনযাপন। এই অগাধ বিশ্বাস কবির জীবনের শেষপর্যন্ত অটুট ছিল। অধ্যাপিকা সুস্মিতা সোম জানালেন, প্রাচীন , মধ্যযুগ পার হয়ে আধুনিক যে বাঙালি তার সঙ্গে নবপরিচয় হতে পারে রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠ করলে। নবজাগরণের আগে আত্মবিস্মৃত যে বাঙালি নতুন করে নিজেকে খুঁজে পায় অথচ দ্বিধা সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেই বাঙালির পরিচয় আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যে পেয়ে থাকি। এটা রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যতম একটি দিক। মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক নিরঞ্জন মৃধার কথায়, বৃহৎ রবীন্দ্রসাহিত্যের মধ্যে যে বিশ্বজনীন আবেদন আছে, তা বয়স ভেবে নির্বাচন করার দরকার হয় না। ছোট বড় সব বয়সের ক্ষেত্রেই তা গ্রহণযোগ্য। বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ে কবির সচেতনতার স্পর্শ পড়েছে তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে আলোচনার পরিসরে উঠে এল সে কথাও। প্রাক্তনীদের মধ্যে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করেন অধ্যাপক পুলক কুণ্ডু ও অনিল দাস। ছিল গান ও কবিতার আয়োজন।
—অনিতা দত্ত

লোক-চর্চা

পশ্চিমবঙ্গ আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের দ্বিতীয় বার্ষিক জাতীয় ইতিহাস সম্মেলনের আমন্ত্রণে যোগ দেন উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তের অধ্যাপক গবেষক ও ছাত্রছাত্রীরা। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ে দু’দিনের এই সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য় স্মৃতিকুমার সরকার। উদ্বোধনী ভাষণে উপাচার্য বলেন,‘‘আঞ্চলিক সত্তা, গোষ্ঠী এবং ভাষার চর্চা এই বিশ্বায়নের যুগে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে’’। প্রধান অতিথি ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় জানালেন,আ়ঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকে জাতীয় ইতিহাস চর্চার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বিশেষ অতিথি, ইতিহাসবিদ আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, ‘‘অ়ঞ্চলের ইতিহাস ও জনগোষ্ঠীর লিখিত ইতিহাসের উপাদান অপ্রতুল। তাই আঞ্চলিক ইতিহাসও লোকসংস্কৃতি চর্চার পরিপূরক হয়ে পড়েছে। উত্তরবঙ্গের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির গুরুত্ব আরও বেশি। তা ছাড়া উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ার কারণে নথিপত্র যথাযথ সংস্করণ সম্ভব হয় না। রয়েছে সরকারি উদ্যোগের অভাব।’’ অন্য অধ্যাপক এবং গবেষকদের আলোচনায় উঠে এল উত্তরবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতি। প্রবীন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের ‘নবাবী অযোধ্যা’ গ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশও ঘটে।

মঞ্চ একুশে


‘মঞ্চ একুশে’র অধিবেশনে কবিতা পাঠের আসর।—নিজস্ব চিত্র

কালিয়াগঞ্জে ‘মঞ্চ একুশে’-র একশো ছিয়াত্তরতম অধিবেশন উপলক্ষে বসেছিল স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর। বিভিন্ন বয়সের একুশ জন কবি নানা স্বাদের এক গুচ্ছ কবিতা পাঠ করেন। আলোচিত হল আধুনিক কবিতা নিয়েও। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ প্রগতি পত্রিকা থেকেই আধুনিক কবিতার সূচনা হল, যা পাঠকের মনে দাগ কাটতে পারে। পঠিত কবিতাগুলির মধ্যে বাধা পড়েছে সমকালীন সময়, গতিতাড়িত জীবন, রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানির ছবি। আলোচনায় যোগ দেন মমতা কুণ্ডু, সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু বিশ্বাস, বিভূতিভূষণ মণ্ডল প্রমুখেরা। কবিতাবাসরে রবীন্দ্রগান শোনালেন স্বপ্না বণিক ও শৈলেন রায়। ‘বেহালা’য় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর শোনালেন বল্লভকুমার মাহাতো। আধুনিক গান শোনান ব্রততী দাস।

রম্যরচনা সমগ্র

‘‘রম্যরচনা সমগ্র’’ (সম্পাদনা শ্যামলী রায়) আদতে রম্যরচনা সংকলন। গল্পগুলিতে লেখকরা হাস্যরসের পাশাপাশি তুলে এনেছেন স্মৃতিকথা এবং ‘মহিলামহল’-এর কথা। কিছু গল্পে বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে সমসাময়িক ঘটনা। প্রজ্ঞা, কাকলি মুখোপাধ্যায়, শ্যামলী রায়, মলয় মৈত্র, বঙ্কিম সরকারের লেখা মনে দাগ কাটে। বিবেক কবিরাজের ‘‘ট্রেন প্রেম’’ এ ‘মালটিপল ইউনিট লোকাল ট্রেনকে নারী এবং ডিজেল বা ইলেকট্রিক ইঞ্জিন মনিটরিং এক্সপ্রেস প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে পুরুষ বলে মনে করা নিঃসন্দেহে অভিনব। প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি সাহিত্যধারাকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি জানাতেই পারে।

ধীমাল-কাহিনি

তাঁর কথা অনুযায়ী ‘‘উত্তরবঙ্গে ধীমাল জনজাতির মোট জনসংখ্যা ১০০৩। এখনও পর্যন্ত দুজন স্নাতক, দুজন স্নাতকোত্তর।’’ প্রথম স্নাতক হয়েছিলেন গর্জন কুমার মল্লিক। পানিঘাটা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক গর্জনবাবু ধীমালদের সম্পর্কে আরও বলেছেন, ‘‘আজও কেউ অসুস্থ হওয়া মানে তুকতাক বা অশুভ হাওয়ার প্রভাব। চিকিৎসক বলতে ওঝা।’’ সেই পরিবেশে শিক্ষায় আগ্রহী হলেন কী ভাবে? ‘‘আমার গ্রাম, অর্থাৎ কেতুগাবুরজোত (নকশালবাড়ি)-এর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন। মাধ্যমিক পাস করার পরে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। তাঁরাই রক্ষা করেছেন।’’ এক সময়ে গ্রামে শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রকাশ করতেন ‘‘নেখেমৈনাকো’ (দ্বিমাসিক) পত্রিকা। একাই লিখছেন ‘‘আউআইকা’ (ঠাঁ ঠাঁ), ‘‘কৌহিনি (লোককথা) এবং ‘‘নালকা’’ (নিজের জাতির পরিচিতি)। স্বকীয় সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদে নাচ শেখান। নাচের গান লেখেন, একক উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘‘ধীমাল অস্তিত্বরক্ষা ও কল্যাণকমিটি’’ এবং ‘ধীমাল লোকসংস্কৃতি রক্ষা দল।’’ গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। বোঝান, শিক্ষার গুরুত্ব। অবসর সময়ে ছড়া এবং কবিতা লেখেন। লেখেন ধীমাল ভাষায় গল্পও। সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৫০টি লোককথা। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা নাটক ‘ডাইনি’’ মঞ্চস্থ হয়েছে শিলিগুড়িতে। বাংলা ভাষায় লেখা উত্তরবঙ্গের জনজাতি ধীমাল গ্রন্থটি প্রকাশের অপেক্ষায়। তিনি সযত্নে লালন করেছেন একটি স্বপ্ন, ‘‘ধীমলারা সবাই একদিন শিক্ষিত হবে। মুক্ত হবে কুসংস্কার। গড়ে উঠবে সংস্কৃতি সচেতনা এবং স্বাবলম্বন। —সুদীপ দত্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন