ফালাকাটায় পড়ে রয়েছে আলু। ছবি: রাজকুমার মোদক।
হিমঘরে আলু মজুতের বন্ড না পেয়ে ফের ধূপগুড়ির চাষিদের একাংশ ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন। মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ শহরের চৌপথী এলাকায় দেড় শতাধিক চাষি পথ অবরোধ করে প্রায় আধ ঘণ্টা অবরোধ করেন। তারপরে বিরাট পুলিশ বাহিনী লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করলে চাষিরা অবরোধ তোলেন। গত রবিবার ঠাকুরপাট এলাকায় একই কারণে চাষিরা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। হিমঘরের বন্ড না পেয়ে আলিপুরদুয়ারেও জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখান আলু চাষিরা।
জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক সীমা হালদার বলেন, “চাষিদের অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু কথায় কথায় পথ অবরোধ বরদাস্ত করা হবে না।” তিনি জানান, চাষিরা সমস্যার কথা তাঁদের জানালে প্রশাসনের তরফে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা জানান, আলুর অতি ফলনের কারণে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা আঁচ করে হিমঘর মালিকদের নিয়ে আলোচনায় বসে কিষাণ বিকাশ পত্র, এপিক কার্ড অথবা জন প্রতিনিধিদের শংসাপত্র দেখিয়ে চাষিদের মাথা পিছু ২০ প্যাকেট থেকে দু’শো প্যাকেট আলু মজুতের বন্ড সংগ্রহের সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তার পরেও বন্ডের সমস্যাকে ঘিরে চাষিদের ক্ষোভের পারদ চড়তে দেখে প্রশাসনের কর্তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, হিমঘর মালিকদের নিয়ে সভা করার পরেও চাষিদের প্রত্যেককে আলু মজুতের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেন?
ধূপগুড়িতে হিমঘরে আলু রাখার বন্ডের দাবিতে রাস্তা অবরোধ । ছবি: রাজকুমার মোদক।
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চাষের এলাকা বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। গত বছর দুই জেলায় আলু উত্পাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ লক্ষ মেট্রিক টন। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উত্পাদন বেড়ে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় মাত্র ২৬টি হিমঘর রয়েছে। সেখানে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন আলু মজুত করা সম্ভব। বাকি আলু কী হবে? কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, হিমঘরের বাইরে থাকা আলুর অর্ধেকের বেশি ভিন রাজ্যে না পাঠালে চাষিদের বিক্ষোভ সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ওই কারণে রাজ্য সরকারের তরফে ব্যবসায়ীদের ভিন রাজ্যে আলু পাঠাতে কুইন্টাল প্রতি ৫০ টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।
ইতিমধ্যে আলু তোলা শুরু হতে পাইকারি বাজারে দাম তলানিতে ঠেকে সাড়ে ৩ টাকা কেজি দাঁড়িয়েছে। অথচ চাষিদের দাবি মতো এক কেজি আলুর উত্পাদন খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ টাকা। জলপাইগুড়ি জেলা কৃষি আধিকারিক সুজিত পাল বলেন, যে আলু উত্পাদন হয়েছে, সেটা জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সমস্যা সেখানেই।
উত্তরবঙ্গ আলু ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর ৫ মার্চ থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য গুলিতে ট্রাক এবং ট্রেনে আলু পাঠানো শুরু হয়। রেল পথে সপ্তাহে ৬ রেক পাঠানো হয়েছে। একটি রেকে ৪০ হাজার প্যাকেট আলু থাকে। এ ছাড়াও দিনে দেড়শো ট্রাক আলু অসম, মেঘালয় নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরায় পাঠানো হয়েছে।
এ বার সড়কপথে ট্রাকে সামান্য আলু পাঠানো শুরু হলেও ১০ মার্চ পর্যন্ত রেলপথে আলু যায়নি কেন? ব্যবসায়ীরা জানান, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এ বার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও ভাল আলুর চাষ হয়েছে। এ ছাড়াও উত্তরবঙ্গে আলুর অতি উত্পাদনের খবর পেয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা আরও দাম কমবে এই আশায় অপেক্ষা করছেন। তাঁদের বরাত মিলছে না। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে এর আগে ২০০৮ সালে একই রকম পরিস্থিতি হয়েছিল।
এদিন মাগুরমারি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বিক্ষোভকারী চাষিদের অভিযোগ, বন্ডের জন্য স্থানীয় হিমঘরে গেলে কর্তৃপক্ষ জানান, বন্ড শেষ। তাঁদের পক্ষে নতুন করে আলু মজুতের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এরপরেই চাষিরা হিমঘরের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ শহরের চৌপথী এলাকায় পৌঁছে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বন্ডের দাবি জানাতে শুরু করেন। চাষি কমল রায় বলেন, “পাঁচ বিঘা খেতের আলু তোলার পরে বন্ডের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথায় আলু রাখব বুঝতে পারছি না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।” এদিনের ঘটনা নিয়ে হিমঘর কর্তারা মুখ খোলেননি। কৃষি বিপণন দফতরের জেলা আধিকারিক সুব্রত দে উদাসীনতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “সমস্যা সমাধানের জন্য সব রকম চেষ্টা চলছে। হিমঘর মালিকদের কাছে কত বন্ড কোথায় ছাড়া হয়েছে, সেই বিষয়ে মঙ্গলবার রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।”