মোহিতনগরের চার্চ। ছবি: সন্দীপ পাল।
অন্ধকারে চলাফেরা দায়। তার মধ্যে সব রাস্তা পাকা নয়। খানা খন্দে ভরা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন অনেকেই। শুধু তাই নয়, গ্রাম এলাকায় সাপ, অনান্য বিষাক্ত পোকারও উপদ্রব রয়েছে। কিন্তু, গ্রাম এলাকায় গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পথবাতি বসানোর প্রকল্প তখন ছিল না। তবে তাই বলে, হতোদ্যোম হয়ে থাকেননি মোহিতনগরের বাসিন্দারা। এলাকার কয়েকজন যুবক এবং প্রবীণরা মিলে এক ছুটির দিনের সকালে চাঁদা তুলতে বের হলেন। উদ্দেশ্য শুনে বাসিন্দারা সাধ্যমতো সাহায্য করলেন। তাই দিয়ে আলো বসানো হল বিভিন্ন মোড়, গলির রাস্তায়। বিভিন্ন বাড়ি থেকে দেওয়া হল বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশ কয়েকবছর এমন চলার পরে, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পথবাতির ব্যবস্থা করা হয়।
সরকারি সংস্থান নেই বলে হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করা মোহিতনগরের ‘ডিএনএ’তে নেই বলে বাসিন্দাদের দাবি। তেমনিই কোনও কিছু দীর্ঘদিন ধরে এমনই চলে এসেছে বলে মেনে নেওয়ার প্রবণতাও এই এলাকার সঙ্গে খাপ খায় না। একসময়ে দুর্গাপুজোর সময় বাসিন্দারা জলপাইগুড়ি শহরের বিগবাজেটের পুজো দেখতে যেতেন। পুজোর দিন গুলো সন্ধ্যার পরে সুনসান হয়ে যেত এলাকায় বেশ কয়েক বছর আগে কয়েকজন যুবক সম্পূর্ণ উল্টো পথে ভাবেন। মোহিতনগরের পুজো দেখতে কেন বাইরে থেকে লোক আসবে না? শুরু হল উদ্যোগ। বাকিটা ইতিহাস। এখন পুজোর দিনগুলি আলোর মাড়া আর হাজার হাজার কালো মাথার ভিড়ে সময়ও যেন দম ফেলার সুযোগ পায় না মোহিতনগরে।
উত্তরবঙ্গের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা উমেশ শর্মা মনে করেন, মোহিতনগরের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই জেদ আর আভিজাত্য সঙ্গী। উমেশবাবু ব্যাখ্যা করলেন, বৈকুন্ঠপুরের রাজ পরিবারে পুজো আর্চা অনান্য নিয়মের জন্য নিয়মিত গঙ্গাজল প্রয়োজন হতো। কলকাতা থেকে গঙ্গাজল তখন রাজবাড়িতে আনা হতো বটে। তবে সে সময় ট্রেন, সরাসরি পাকা সড়ক অনেক কিছুই ছিল না। যোগাযোগের অনেক হ্যাপা ছিল, অনেক সময়ও লাগত। রাজপরিবারকে গঙ্গা জলের সমস্যা থেকে সমাধান খুঁজে দেয়মোহিতনগর। এখানে করলা নদী উত্তর দিকে বইছে। প্রাচীন কাল থেকেই উত্তরবাহিনী নদীগুলিকে পুন্যতোয়া মনে করা হয়। গৌরীহাটের কাছে করলার জলকে গঙ্গাজল হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। তার পর থেকে মোহিতনগরের সঙ্গে রাজ পরিবারের যোগাযোগ, পত্তন হয় গৌরীহাটেরও।
মোহিত মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
• জন্ম: ১৮৯৯। কলকাতা
• পড়াশোনা এবং বসবাস: পাবনা জেলার বেরা থানার ভারাঙ্গা গ্রাম।
• রাজনীতি: যুগান্তরের সক্রিয় সদস্য।
• গ্রেফতার: খিদিরপুর ডক থেকে অস্ত্র আইনে, ১৯৩২-এ ৯ ফেব্রুয়ারি।
• পরবর্তীতে: আন্দামানে সেলুলার জেলে বন্দি। বন্দিদের নানা সুযোগ সুবিধে দেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু। টানা ৮৩ দিন অনশনের পরে, জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করে ইংরেজ পুলিশ। সে সময়েই মৃত্যু।
• মৃত্যু: ১৯৩৩
(সূত্র: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জলপাইগুড়ি, লেখক উমেশ শর্মা)।
স্বাধীনতার তিন বছর আগে তৈরি হয় মোহিতনগর স্টেশন। দীর্ঘদিন আগেই বসবাস শুরু হয়ে গেলেও, মোহিতনগর নামকরণ হয় পঞ্চাশের দশকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর এবং পাবনার বাসিন্দাদের জন্য রাজপরিবারের ৯০০ একর জমি খাস করে স্থাপিত হয় কলোনি। কলোনির নামকরণও এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিত মিত্রের নামে নাম রাখা হয় মোহিতনগর। যতদূর জানা যায় মোহিত মিত্রের কর্মকাণ্ড এই এলাকায় ছিল না। পাবনার বাসিন্দা মোহিত মিত্রের কর্মস্থল ছিল রংপুর। খিদিরপুরে অস্ত্র আইনে ধৃত মোহিতবাবু আন্দামানে ব্রিটিশ সেলুলার জেরে বন্দি ছিলেন। অনশন ভাঙতে, জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টায় মৃত্যু হয় তাঁর। পাবনা এবং রংপুরের বাসিন্দাদের জন্য তৈরি কলোনির নাম রাখা হয় মোহিতবাবুর নামেই। কলোনি প্রতিষ্ঠার পরে শুরু হয় শিক্ষা এবং সাংস্কৃতির চর্চা। তৈরি হয় স্কুল, সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ। এলাকার নাটকের দল, গানের দল সাড়া ফেলে দেয় উত্তরবঙ্গে। উমেশবাবুর কথায়, “সে সময়ে মোহিতনগরকে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির পীঠস্থানে পরিণত করতে একদল মানুষ নিজেদের মতো করে এগিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ শিকদার, তারাপদ বিশ্বাস, মন্ন্দ্রনাথ বাগচী, হরিপদ ঘোষ, কালীপদ বিশ্বাস, প্রফুল্ল বাগচী, দীননাথ ভট্টাচার্য, দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনিল নিয়োগী, ক্ষীরোদ করের মতো ব্যক্তিত্বরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের যে কাজ শুরু হয়েছিল, তার উপস্থিতি দেখা যায় মোহিতনগরে।” এখানকার চার্চও পর্যটকদের টানে।
জেলা সদর জলপাইগুড়িতে চা শিল্পের মুখ ফেরানোয় অথনৈতিক মন্দার আলোচনা বহু চর্চিত। কিন্তু সদরের কাছে মোহিতনগর কিন্তু শিল্প উপনগরী হিসেবেও পরিচিত। চা কারখানা থেকে হিমঘর, চালের মিল, বেকারি শিল্প গড়ে ওঠে মোহিতনগরে। সেই ধারা এখনও চলছে।
(চলবে)