সোমবার মালকানিতে পালিত হয় ব্যবসা বন্ধ। ছবি: সন্দীপ পাল।
পুলিশ-প্রশাসনের ‘নজরদারি’ রয়েছে। তা সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার হাটে-বাজারে রমরমিয়ে জুয়ার আসর বসছে। চলছে বেআইনি মদের কারবারও। রায়গঞ্জ থেকে জলপাইগুড়ি, হাটে-বাজারে উঠছে একই অভিযোগ। শোনা যাচ্ছে একই অভিজ্ঞতা। জলপাইগুড়ির মালকানি হাটে মদ-জুয়ার আসরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একজনকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তার পরেও কিন্তু, অবস্থা পাল্টায়নি। বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, এখনও বেশির ভাগ এলাকাতেই আসরে নামেনি পুলিশ-প্রশাসন।
প্রথমে ডুয়ার্সের কথাই ধরা যাক। তিন মাস ধরে ধূপগুড়ি থানার আংরাভাসা গ্রামে ফি রবিবার জুয়ার আসর বসাচ্ছে এক শ্রেণির সমাজবিরোধীরা। এমনই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। রবিবার বেশির ভাগ চা বাগানে কাজকর্ম বন্ধ থাকে। আংরাভাসা বাজারে সাপ্তাহিক কেনাকাটা করতে যাওয়া বাগানের শ্রমিকেরা দালালের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। শুধু বাগানের শ্রমিকেরাই নন, গ্রামের বহু মানুষও জুয়ার আসরে সব খোয়াচ্ছেন বলে বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। জুয়ার আসর বন্ধ করার জন্য পুলিশকে মৌখিক ভাবে কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করলেও তাতে কোনও ফল মিলছে না বলে জানাচ্ছেন ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, “চার মাস আগে পর্যন্ত এই জুয়াড়িরা গয়েরকাটা হাটে আসর বসাত। তবে সেখানকার মহিলারা জোট বেঁধে প্রতিবাদ করলে জুয়ার আসর বন্ধ হয়ে যায়। ওই ঘটনার এক মাস বাদে গয়েরকাটা থেকে চার কিলোমিটার দূরে ফের নতুন করে আসর বসতে শুরু করে।” জুয়ার আসর বসানোর পিছনে কিছু প্রভাবশালী লোকজনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। সেখানকার লোকজনের এমনকী, পুলিশকে হাতে নিয়েই ওই জুয়ার আসছেন নিয়মিত বসছে বলে ক্ষোভ স্থানীয়দের অনেকেরই।
মালবাজারের পুর এলাকা কিংবা চালসা, নাগরাকাটা ওদলাবাড়ির সাপ্তাহিক হাটেও ছবিটা একই। পুলিশ-প্রশাসন জুয়া বন্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি বলেই দ্রুত জুয়ার আসর বেড়েছে বলেও অভিযোগ। মালবাজার পুর এলাকার থেকে ৫০০ মিটারের দূরে মালবাজার বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকাতে দিনরাত সব সময়েই জুয়ার আসর বসে। একই রকম ভাবে ওদলাবাড়ি হাট কিংবা চালসার মঙ্গলবাড়ির হাট সব ক্ষেত্রেই লুডোর ঘুঁটির ছক ঘুরিয়ে জুয়া চলছে। তাসের তিনপাত্তির আসরও একই ভাবে জুয়াড়িদের ভিড়। চা বাগানের ভিতরে ছোট বাজারেও জুয়ার আসর বসে। টাকা দ্বিগুণ-তিনগুণ করার নেশায় চা শ্রমিকেরা খুব দ্রুতই মজে যান। শেষে সর্বস্বান্ত হতে হয়।
ডুয়ার্স থেকে দিনাজপুরে এলে বদলে যায় ভূপ্রকৃতি। তবে জুয়াড়ি-পুলিশের একাংশের আঁতাতের অভিযোগটা একই থাকে। পুলিশের একাংশের মদত ও নিষ্ক্রিয়তায় উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর মহকুমার চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর ও করণদিঘি থানা এলাকার একাধিক হাটে প্রকাশ্যে জুয়া ও মদের ঠেক চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জলপাইগুড়িতে প্রতিবাদী স্বপন সরকাররে খুনের পরে জুয়ার আসর বন্ধ করতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর ও করণদিঘি থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।
মালকানি হাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে হাটগুলিতে জুয়া ও মদের আসর বন্ধের দাবিতে পৃথকভাবে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকও। ফরওয়ার্ড ব্লক ও বাসিন্দাদের দাবি, এলাকার সুষ্ঠ পরিবেশ বজিয়ে রাখতে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একাধিকবার পুলিশের কাছে মৌখিকভাবে হাটগুলিতে জুয়া ও মদের ঠেক বন্ধ করার দাবি জানানো হলেও কোনও লাভ হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে বাসিন্দারা লিখিতভাবে পুলিশে অভিযোগ জানাননি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের একাংশের মদত ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই তিনটি থানার একাধিক হাটে নিয়মিত জুয়া ও মদের ঠেক চলছে। মাঝেমধ্যে লোকদেখাতে পুলিশ হাটগুলিতে অভিযান চালায়। তবে পুলিশের সঙ্গে জুয়াড়িদের অবৈধ লেনদেন ও গোপন বোঝাপড়া থাকায় অভিযান চলাকালীন সাময়িকভাবে হাটগুলিতে জুয়া ও মদের আসর বন্ধ থাকলেও পুলিশ চলে যেতেই হাটগুলিতে ফের একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ ওয়াকার রেজা জানান, চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর ও করণদিঘি থানা এলাকার একাধিক হাটে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে জুয়া ও মদের ঠেক চলছে বলে তিনি কিছুদিন আগে বাসিন্দাদের একাংশের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, “জুয়া ও মদের ঠেক বন্ধ করতে তিনটি থানার পুলিশকে দীর্ঘদিন আগেই সর্বক্ষণ নজরদারি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি।” তিনি জানান, কোনও পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপে মদত দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে!
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও বুধবার চাকুলিয়া হাট, মঙ্গলবার ও শুক্রবার জনতা হাট, রবিবার ও বৃহস্পতিবার গররা হাট এবং সোমবার ও বৃহস্পতিবার টুঙ্গিদিঘি হাট বসে। অভিযোগ, প্রতিটি হাটেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রকাশ্যে একাধিক জুয়া ও মদের ঠেক চলে। তাসের বিভিন্ন চিহ্ন যুক্ত প্লাস্টিকের গুটির মাধ্যমে চলা ওই জুয়ার আসর স্থানীয়দের ভাষায় ‘ফরগুটি’ বলে পরিচিত! জুয়ার আসরের পাশেই পাল্লা দিয়ে চলছে দেশি ও নকল বিলিতি মদের ঠেক। বাসিন্দা ও পড়ুয়াদের একাংশ সেইসব জুয়া ও মদের ঠেকে দিনভর ভিড় করছেন। অনেকে হাটে গিয়ে গরু, ছাগল, সাইকেল, ধান, গম-সহ বিভিন্ন ফসল বিক্রি করে জুয়া খেলে সর্বস্বাান্ত হচ্ছেন। জুয়ার আসরে কারচুপির অভিযোগকে কেন্দ্র করে বাসিন্দাদের একাংশ জুয়ার কারবারিদের সঙ্গে হামেশাই গোলমালে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনই গোলমাল থেকেই জলপাইগুড়ির মালকানি হাটে প্রাণ হারাতে হয় ব্যবসায়ী স্বপন সরকারকে। জুয়ার নেশায় টাকা জোগাড়ের জেরে এলাকার বিভিন্ন দোকান, বাড়ি ও মন্দিরে চুরির ঘটনাও বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন বাসিন্দারাই।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন বিধায়কও। চাকুলিয়ার ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক আলি ইমরান রমজের অভিযোগ, “জুয়া ও মদের ঠেক বসানোর বিনিময়ে পুলিশকর্মীদের একাংশ নিয়মিত চাকুলিয়া, জনতা ও গররা হাট থেকে তোলা আদায় করেন। দীর্ঘদিন ধরে দলের তরফে একাধিকবার পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনও লাভ হয়নি। অবিলম্বে জুয়া ও মদের ঠেক বন্ধ করে অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দলের তরফে টানা আন্দোলনে নামা হবে।”
এই পরিস্থিতিতে পুলিশের উপরে ভরসা করতে পারছেন না বাসিন্দারা অনেকেই। টুঙ্গিদিঘি এলাকার বাসিন্দা তথা রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের টিচার্স কাউন্সিলের প্রাক্তন সম্পাদক মিলন রায়ের দাবি, পুলিশকর্মীদের একাংশ প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের তোলা আদায় করে টুঙ্গিদিঘি হাটে জুয়া ও মদের ঠেক চালানোর কাজে মদত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “পুলিশের উপর বাসিন্দাদের ভরসা নেই। তাই মালকানি হাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া ও করণদিঘি থানা এলাকার বাসিন্দারা যৌথমঞ্চ গঠন করে হাটগুলিতে জুয়া ও মদের ঠেক বন্ধ করতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’’ করণদিঘির ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক গোকুল রায় জানান, এলাকার সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে বাসিন্দাদের আন্দোলনে দলীয় কর্মী সমর্থকেরাও সামিল হবেন।